জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সৌরবিদ্যুতে বড় বিনিয়োগ করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা
তীব্র জ্বালানি সংকটে বিদ্যুতের সরবরাহে টান পড়ায় এবং ভবিষ্যতে বিদ্যুতের মূল্য আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিকল্প হিসেবে শিল্প কারখানাগুলোতে ব্যবহার হওয়া বিদ্যুতের একটি অংশ নিজস্ব উদ্যোগে উৎপাদন করা তথা সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পথে হাঁটছেন অনেক শিল্পোদ্যোক্তা।
আবার কোনো কোনো উদ্যোক্তা বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিও স্থাপন করছেন। গ্যাসের কম চাপেও চলে, এমন বয়লার স্থাপন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
উদ্যোক্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানিয়েছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানিসহ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের টেকসই সমাধান দেখছেন না।
আবার ক্রমাগত বিদ্যুৎ বিলও বাড়তে থাকবে, যা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচের কাছাকাছি চলে আসবে বলে উল্লেখ করেন উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি পোশাকপণ্যের ক্রেতাদের ওপরও সরবরাহ চেইনের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি তথা গ্যাস ও কয়লানির্ভর বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর চাপ রয়েছে। ফলে তারাও বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের কাছে এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চাচ্ছে।
অন্যদিকে আপাতত পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিজেলের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নিট পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জসহ দেশের কয়েকটি এলাকার কারখানাগুলো তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে ডিজেল জেনারেটর চালাতে বাধ্য হচ্ছে। একদিকে তাদের গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে, অন্যদিকে ডিজেল ব্যবহারের ফলে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কিছু শিল্প সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে তাদের বিদ্যুতের চাহিদার একাংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পূরণ করার পথে হাঁটছেন বলে উদ্যোক্তারা টিবিএসকে জানিয়েছেন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল কারখানার মালিক রাইজিং গ্রুপ সম্প্রতি তাদের মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরের দুটি কারখানায় ২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে রুফটপ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। মানিকগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১২ মেগাওয়াট। গাজীপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৩ মেগাওয়াট।
রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, 'আমাদের কাছে মনে হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের সংকট কাটবে না। জ্বালানির মূল্যও অনিশ্চিত। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, বিদ্যুতের দামও ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।
'এজন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ব্যবহার হওয়া বিদ্যুতের একটি অংশ সোলার প্যানেলের মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা করছি। এটি সাসটেইনেবল গ্রিন এনার্জি ইনিশিয়েটিভেরও একটি অংশ।'
গ্রুপটির দুটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর। কেন্দ্র দুটি বছরে ৫ হাজার ২৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে জানান মাহমুদ। এতে ২৫ বছরে ৬৩ হাজার ৭৫১ টন কার্বন ডাই অক্সাইড (CO²) নিঃসরণ কমবে এবং প্রায় ৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৫৯ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল সাশ্রয় হবে।
মানিকগঞ্জে কারখানায় ৩.৬ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যমান সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে রাইজিং গ্রুপ। নতুন সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রায় ৫৫ হাজার টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO²) নিঃসরণ কমাবে এবং আয়ুষ্কালে চার লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল সাশ্রয় করবে।
অন্তত চারজন শিল্পমালিক টিবিএসকে জানিয়েছেন যে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য জ্বালানি সংকট মোকাবিলার দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
দেশের অন্যতম শীর্ষ টেক্সটাইল উৎপাদক নোমান গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেডের ইতিমধ্যে ৪০০ কিলোওয়াট সক্ষমতার একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ১ মেগাওয়াটের নতুন একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। নোমান গ্রুপের আরো একাধিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান একই পথে হাঁটছে।
নারায়নগঞ্জের ফকির ফ্যাশনস লিমিটেড ২ মেগাওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। গাজীপুরের মোশারফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করছে বলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন টিবিএসকে জানিয়েছেন।
নিটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ নতুন করে এ পথে হাঁটছেন বলেও জানা গেছে।
অন্যদিকে নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমেও বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে আনা কিংবা কম গ্যাসের চাপেও কারখানা চালু রাখার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
অবশ্য দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তার ১ শতাংশেরও কম নবায়নযোগ্য শক্তি বা সৌরশক্তির মাধ্যমে হয়।
ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) নির্বাহী পরিচালক ও সিইও আলমগীর মোরশেদ সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেছেন, দেশে রুফটপ সোলার প্ল্যান্টের মাধ্যমের ৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, অপেক্ষাকৃত কম গ্যাস বা বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়, এমন কারখানার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি হয়তো কিছুটা উপকারে আসবে। কিন্তু তা গ্যাসের বিকল্প হতে পারবে না।
জ্বালানি সাশ্রয়ী মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে
ফতুল্লা ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান টিবিএসকে বলেন, তার কারখানায় গ্যাসের অনুমোদিত চাপ ১০ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চ), কিন্তু প্রায়ই তা ২ পিএসআইয়ের নিচে নেমে আসে।
কারখানাটিতে চারটি বয়লার রয়েছে। কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি একটি বয়লার বদলেছে, যেটি ২ পিএসআই চাপেও চলবে।
এহসান জানান, বাকি তিনটি বয়লারও পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন তিনি।
তিনি আরও জানান, অন্যান্য কারখানার উদোক্তারাও এভাবে মেশিনারিজ পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন।
সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডও কিছু মেশিনারিজ পরিবর্তন করেছে, যার ফলে বিদ্যুতের ব্যবহার ১৮ থেকে ২০ শতাংশের মত কমানো গেছে।
প্রতিষ্ঠানটি চেয়ারম্যান মো. খোরশেদ আলম টিবিএসকে, তারা পরীক্ষামূলক নতুন এ প্রযুক্তি মেশিনারিজ স্থাপনের মাধ্যমে সফলতা পেয়েছেন। এটি ব্যাপকভাবে শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
আছে চ্যালেঞ্জও
তবে উদ্যোক্তারা টিবিএসকে জানিয়েছেন, নিজস্ব উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন কিংবা নতুন প্রযুক্তি ও মেশিনারিজ ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে।
সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেশি, যা অনেক উদ্যোক্তার পক্ষে বহন করা কঠিন। আবার সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রচুর খোলা জায়গা লাগে, যা সব কারখানার পক্ষে সম্ভব হয় না।
উপরন্তু কেবল সূর্যের আলোর ওপর নির্ভর হওয়ায় সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের পরিমাণও খুব বেশি হয় না।
এছাড়া শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাসভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে ব্যয় ৫ থেকে ৬ টাকা, সেখানে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় প্রায় ৯ টাকা।
অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি সবার জন্য সহজ সমাধানও নয়। কেননা উদ্যোগ নেওয়ার পর একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসতেও ৬ মাস সময় লাগে।
ডিজেলের ব্যবহার বাড়ায় বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়
সরকারের কৃচ্ছ্রতা সাধনের অংশ হিসেবে গ্যাস ও বিদ্যুতে রেশনিং করার ফলে দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এসব ইউটিলির সরবরাহ কমেছে। লোডশেডিং বেশি হওয়া ও গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করতে হওয়ায় ব্যয় বেড়ে গেছে উদ্যোক্তাদের।
শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের সংকট বর্তমানে মারাত্মক। এছাড়া সাভার, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জের কিছু এলাকায়ও গ্যাসের সরবরাহ কম।
নারায়ণগঞ্জভিত্তিক নিট পোশাক কারখানা প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, ডিজেল ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়ায় মাসে তার ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।
ফতুল্লা ডায়িং-এর বাড়তি খরচ হচ্ছে মাসে প্রায় ২.২৫ কোটি টাকা।
অন্যান্য কারখানা মালিকরাও এ কারণে একইভাবে তাদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নিটওয়্যার কারখানার মালিক টিবিএসকে জানান, কেবল ডিজেলের বাড়তি খরচের জন্যই প্রতি পিস টি-শার্টের উৎপাদন খরচ ০.৪০ ডলার বেড়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে কারখানাগুলো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে, পরিণতিতে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধও কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।