চট্টগ্রামের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড: ৬ কিলোমিটার সড়ক নিয়ে যত জটিলতা!
রেললাইনের ওপর চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোড ওভারপাসের উচ্চতা হবে ৭ দশমিক ৫ মিটার। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে সড়ক নির্মাণ সংস্থার চলা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক নির্দেশনায় এমনটি বলা হয়।
সিডিএ বলছে, তারা আগামী দুই মাসের মধ্যে ওভারপাসটির নির্মাণ কাজ শুরু করবে এবং ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ বাইপাস সড়কটির কাজ শেষ করতে সক্ষম হবে।
চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি থেকে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি নয় বছরেও। পাহাড় কাটার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা এবং রেলওয়ে ব্রিজের উচ্চতা নিয়ে আপত্তির কারণে ঝুলে আছে শহর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওঠার বিকল্প সড়কটির নির্মাণ কাজ। খাড়া পাহাড় ধসের কারণে বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে সড়কটি। এছাড়া মহাসড়কে ওঠার মুখে ইউলুপ বা ওভারপাসের ব্যবস্থা না থাকায় ঘটছে দুর্ঘটনা। ২০১৩ সালে হাতে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ পাঁচ দফা বাড়িয়েও জটিলতা কাটাতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সর্বশেষ চলতি বছরের আগস্টে ব্যয় ও সময়- দুটিই বাড়ানো সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তবে বাড়তি ব্যয় ৩২ কোটি টাকার সংস্থান সিডিএকে বহন করতে বলা হয়েছে। আর এই ব্যয়ের বোঝা জনগণের কাঁধে তুলতে ৬ কিলোমিটার সড়কের জন্যও টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। এ নিয়ে সমালোচনা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
প্রকল্প পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকল্পটির কাজ ৯০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। এখন শুধু রেলওয়ের ওভারব্রিজ, পাহাড় সংরক্ষণের প্রটেকশন ওয়াল এবং সড়কবাতির কাজ বাকি। নকশায় কিছু পরিবর্তন আনার কারণে ব্যয় ৩২০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩৫২ কোটি টাকা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। আমাদের এখন ফোকাস হলো কাজটি দ্রুত শেষ করা।"
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পুরো বিষয়টিই অপরিকল্পিত। এর খেসারত দিতে হবে জনগণকে। এখানে টোলের হার কেমন হবে, এর উপর সড়কটির কার্যকারিতা নির্ভর করবে। তারা প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় তোলার সময়সীমা বাড়িয়ে টোলের পরিমাণ কমাতে পারে।"
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সড়কটির আশেপাশে ছোট-বড় ১৮টি পাহাড় রয়েছে। সড়ক নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সিডিএকে। কিন্তু বাস্তবে ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটা হয়। এজন্য ২০২০ সালে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি মামলা করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এছাড়াও প্রকল্পটির পরিবেশগত ছাড়পত্রের মেয়াদোর্ত্তীর্ণ হয় ২০২০ সালের মে মাসে। এরপর ঝুঁকিপূর্ণ খাড়া পাহাড়গুলো নতুন করে কেটে সুরক্ষা এবং ছাড়পত্র নবায়নের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে পুনরায় আবেদন করে সিডিএ। ওই আবেদনে নতুন করে ৩ লাখ ৩২ হাজার ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি চায় সংস্থাটি। এরপর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো কাটা ও সংরক্ষণ কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে সিডিএর কাছে বিশেষজ্ঞ মতামতসহ প্রতিবেদন চায় পরিবেশ অধিদপ্তর। পাহাড় ধসের আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে বর্ষা মৌসুমে ২০২১ সালের জুন মাসে সড়কটি এক সপ্তাহ বন্ধ রাখা হয়েছিল। সড়কটির ফুটপাতে পাহাড় ধসে মাটি এখনও পড়ে আছে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জরিমানা মওকুফের জন্য আপিল করেছিল সিডিএ। এটি বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে পেন্ডিং আছে। তাদের বলা হয়েছিল, বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে। তারা সেটি এখনো জমা দেয়নি।"
এদিকে সড়কটির রেল ওভারব্রিজের উচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
সিডিএর তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালে ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ পর্যন্ত দুই লেনের সড়কের নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ১৯৯৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (একনেক) অনুমোদন হয় প্রকল্পটি। ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার ওই প্রকল্পটির জন্য ২০০৪ সালে ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সড়কের ফৌজদারহাট অংশের কিছু কাজ শুরু হলেও এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটির সঙ্গে ভূমি নিয়ে বিরোধ বাঁধে। ফলে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ১৭২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার চার লেন সড়কের নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে যানজট নিরসন করা এবং ঢাকা অভিমুখী যানবাহনসমূহে শহরকে বাইপাস করে সহজে যান চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করা। তখন প্রকল্পে মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর পাঁচ দফা সময় বাড়িয়েও প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি সিডিএ। এরমধ্যে ব্যয় বাড়িয়ে ৩২০ কোটি টাকাও করা হয়েছিল। ২০২০ সালে ফৌজদারহাট অংশের রেলওয়ে ওভারপাসের নির্মাণ কাজ বাকি রেখে সড়কটি গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের আগস্ট মাসে আরেক দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৩৫৩ কোটি টাকা করা হয়। বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়।
ইউলুপ বা ওভারপাস নেই, সংকীর্ণ মহাসড়কে দুর্ঘটনা
বায়েজিদ লিংক সড়কের ঢাকা অভিমুখী মুখটি ফৌজদারহাটের বাংলা বাজারে গিয়ে মিলেছে। এর বিপরীতে রয়েছে আউটার রিং সড়কের মুখ। একই স্থানে দুই সড়কের মুখের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের এই অংশটি সংকুচিত হয়েছে। দুটি রুটে গাড়ি যাতায়াত এবং ইউটার্নের কারণে সৃষ্টি হয় যানজট। এখানে কোন ওভারপাস বা ইউলুপ নেই। বায়েজিদ লিংক সড়ক থেকে যানবাহন বেরিয়ে ইউটার্ন নিতে প্রায় ৩০০ মিটার পেছনে যেতে হয়। অনেকে সময় বাঁচাতে উল্টো পথেও চালায় গাড়ি। ফলে সড়কে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় বহনের সামর্থ সিডিএর নেই। তাই টোল আদায় ছাড়া উপায় নেই। প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আমরা চেষ্টা করছি। পরিবেশ অধিদপ্তরে আপিল করা হয়েছে। অনুমতি মিলছে না। তারা বুয়েট-চুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মতামত চায়। সেখানে অনেক টাকা খরচ হবে। আমরা বিদেশি পরামর্শক সংস্থা দিয়ে পাহাড় সুরক্ষার নকশা করিয়েছি। সেটিও তারা গ্রহণ করছে না।"
তিনি আরো বলেন, "ফৌজদারহাটে ইউলুপ বা ওভারপাস নির্মাণের উদ্যোগ আমরা নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সড়ক বিভাগ বলেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বর্ধিতকরণের কাজ করবে।"
সড়ক বিভাগ চট্টগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইউলুপ বা ওভারপাস নির্মাণ অনেক ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। যানজট ও ইউটার্নের সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"