পাহাড়ি বসতি উচ্ছেদ করে স্থাপনা নির্মাণ করতে চায় সরকারি-বেসরকারি ২০০ প্রতিষ্ঠান
সীতাকুণ্ড রিজার্ভ ফরেস্ট সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকা জঙ্গল সলিমপুর। প্রায় ৩১০০ একর জায়গা জুড়ে এটি বর্তমানে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বস্তি; ধারণা অনুযায়ী এ স্থানে প্রায় এক লাখ মানুষের বসবাস। এ এলাকার ৪৫টি পাহাড়ে প্রায় ২০০ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি চেয়ে আবেদন করেছে জেলা প্রশাসকের কাছে।
এর মধ্যে রয়েছে বিজিএমইএ, চট্টগ্রাম সিটিকর্পোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসা, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, র্যাব, পুলিশ ও আনসার।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পাহাড় রক্ষা ও সরকারি জমি উদ্ধারের জন্য উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে প্রায় ৭০০ একর জমি উদ্ধার করেছে। বাকি জায়গাটি উদ্ধারের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এ বিষয়টিই নজর পড়ে সকলের। এছাড়াও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নিজেও এই খাস জমিতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, নভোথিয়েটার, স্পোর্টস ভিলেজ, হাসপাতাল, জাতীয় তথ্যকেন্দ্র, নাইট সাফারি পার্কসহ একাধিক সরকারি স্থাপনা তৈরি করতে চায়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বায়েজিদ এলাকা থেকে এক কিলোমিটার দুরত্বের এই এলাকাটি একসময় ছিলো পাহাড়ি জঙ্গল। নগরীতে বিভিন্ন সময়ে বস্তি উচ্ছেদের পর ভূমিহীন মানুষেরা এই জঙ্গলে গিয়ে বসতি শুরু করে। নব্বই দশক থেকেই সেই পাহাড়ে বসতি শুরু হয়। ভূমিহীন মানুষের এই অবহেলিত জঙ্গলসলিমপুরের নাম হয় ছিন্নমূল।
গত ১২ সেপ্টেম্বর সলিমপুর জঙ্গলে ৩ হাজার ১০০ একর জমি সাফ করে একাধিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক বৈঠকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
এদিকে পাহাড়ে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের খবরে পাহাড়ের খাস জমি বরাদ্দ পেতে প্রভাবশালীরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ১২৩ একর ভূমি চাওয়া হয়েছে। সেখানে এন্টারটেইনমেন্ট জোন, মাল্টিপারপাস কনভেনশন সেন্টার, কিচেন মার্কেট, হলিডে মার্কেট, আবাসিক এলাকা, শপিং কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে চায় সংস্থাটি।
এছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ একর এবং স্বতস্ত্র গার্মেন্টস জোন স্থাপনের সরকারের কাছে ২০০ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছে।
তবে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জঙ্গল সলিমপুরে জমি বরাদ্দ পেতে আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ২০০টি আবেদন পেয়েছি। তবে সরকারি খাস জমিতে কোনো ধরনের বেসরকারি স্থাপনা গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। এখানে শুধুমাত্র সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। সেটিও মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি উচ্ছেদের ঘোষণাটি শুনতে ভালো লাগলেও, পরবর্তিতে পাহাড়ে অবকাঠমো গড়ে তোলার যে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে সেটি ভয়ংকর। যেখানে পাহাড় রক্ষার জন্য উচ্ছেদ চালানো হচ্ছে, সেখানে আবার অবকাঠামো নির্মাণের তৎপরতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামান বলেন, 'পাহাড়েই কেন কারাগার, হাসপাতাল বা নভোথিয়েটার করতে হবে তা আমার বোধগম্য নয়। একদিকে পাহাড় কাটার দায়ে কিছু মানুষকে উচ্ছেদ করার পর যখন সরকারি স্থাপনা তৈরি করা হবে, তখন প্রশাসনই পাহাড় কাটবে। স্থাপনাগুলোকে কেন্দ্র কেরে শুরু হবে নগরায়ন; যা জীববৈচিত্রকে হুমকির মুখে ফেলবে।'
যেভাবে গড়ে উঠে ছিন্নমূল
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত শহরমুখি বাস্তুচ্যুত মানুষরা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বাইরে কিন্তু নগর লাগোয়া সরকারি পরিত্যাক্ত জঙ্গল ও পাহাড়ি ভূমি এই জঙ্গল সলিমপুরে বিনা বাধায় নব্বই দশকের দিকে ক্রমান্বয়ে বসতি গড়তে শুরু করে।
বিগত সময়ে চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট বস্তি, বাটালি হিল, মতিঝর্ণা, ঢেবার পার বস্তি, বরিশাল বস্তি, লালদিয়ার চর, নোমান বস্তিসহ অন্তত ২০টি বস্তি থেকে কয়েক হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
উচ্ছেদ হওয়া মানুষ গুলোর ঠিকানা হয়ে উঠতে থাকে এই ছিন্নমূল। সর্বশেষ ২০২১ সালে পুলিশ সুপারের পাহাড়, লালদিয়ারচর থেকে উচ্ছেদ হওয়া কয়েক শত উদ্বাস্তুদেরও ঠিকানা হয়েছিলো এই ছিন্নমূল বস্তি।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপকূলী উপজেলা ছাড়াও কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, কুমিল্লার জলবায়ু উদ্বাস্তু ও নিম্ন আয়ের মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠে এই ছিন্নমূল।
চট্টগ্রামের বস্তিবাসীদের মধ্য কমপক্ষে ৭০ শতাংশ মানুষই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুভিটা হারিয়ে এখানে এসেছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ রেজা কায়সার। বসবাসকারীরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ- পোশাক শ্রমিক, রিকশাচালক, ও দিনমজুর।
জঙ্গল সলিমপুরে এই বসতি নিয়ন্ত্রিত হয় চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ এর অধীনে, তাদের তথ্যমতে এখানে বর্তমানে প্রায় ২৪ হাজার পরিবারের বসবাস।
তবে সীতাকুণ্ড উপজেলার ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জঙ্গল সলিমপুর ১৬ হাজার ৪০০টি প্লটে, ১০ হাজার ৯৫০টি পরিবারের বসবাস।
২০০৪ সালে গঠিত হয় চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ।
সরকারি সুযোগ সুবিধা না পেয়ে তারা এই ১৮ বছরে নিজেদের মত করে সেখানে রাস্তা-ঘাট, স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে তোলে।
প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ প্রধান সড়কটি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করেছেন বস্তিবাসিরা। বৈধভাবে আবাসিক সংযোগ না পেলেও বিদ্যুৎ বিভাগকে ম্যানেজ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিদ্যুতের বানিজ্যিক সঞ্চালন লাইন। স্থানীয় সাংসদ ও কিছু দাতব্য সংস্থা সেখানে বিদ্যালয়, মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে দিয়েছেন।
জঙ্গল হওয়ায় আইনশৃংখলা বাহিনীর বেগ পেতে হতো এই বস্তি তদারকিতে। ছিন্নমূলের ৮৫০ একর এলাকার বাইরে প্রায় ২,২৫০ একর এলাকায় ভূমিদস্যুরা বিভিন্নভাবে দরিদ্র মানুষের কাছে বাড়ি বিক্রি ও ভাড়া দিচ্ছে।
বসতি শুরু হলে সরকারি অফিসার, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিকসহ অনেকেই সেখানে প্লট নিয়ে এই শহরমুখী গরীদের মাঝে ভাড়া দেন। সেখানে ঘটতো অপরাধ কর্মকাণ্ডও।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড়ে বসতি সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোর ব্যর্থতার কারণে হয়েছে। এই মুহুর্তে এত বিশাল জন সংখ্যাকে পুনর্বাসন করা একটি চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে সরকার চাইলে হাটহাজারির দিকে যে বিশাল খাস জমি আছে সেখানে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে পারে।'
২০১৭ সালে চট্টগ্রাম মহানগর বস্তিবাসি সংগ্রাম পরিষদের দায়ের করা একটি রিট আপিলের প্রেক্ষিতে বিচারপতি এস.এম এমদাদুল হক ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী দেওয়া রায়ে বলা হয়, 'ন্যায়বিচারের জন্য আবেদনকারী চট্টগ্রাম, মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সোমনি সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হবে না, যদি না তাদের অন্যত্র পুনর্বাসন করা হয়।'
আইনজীবি মনজিল মোরশেদ টিবিএসকে বলেন, 'পাহাড়ে সরকারি স্থাপনা তৈরির আইনগত কোনো সুযোগ নেই। সরকারি স্থাপনা নির্মানের জন্য যদি শুধুমাত্র ওই এলাকাটি (ছিন্নমূল) থেকে মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়, তাহলে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে।'
শহরমুখী মিলিয়ন উদ্বাস্তু
বাংলাদেশে নগরায়ণের একটি অপরিহার্য উপসর্গ হিসাবে দেখা দিয়েছে বস্তি। কাজের সন্ধান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও উচ্ছেদসহ নানা কারণে দিনে দিনে চট্টগ্রাম শহরে বাড়ছে বস্তিবাসীর সংখ্যা।
২০১৮ সালে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির 'বাংলাদেশে উপকূলীয় জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির লবণাক্ততা এবং মানব অভিবাসন' শীর্ষক একটি সমীক্ষা অনুসারে, "মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রাম এবং খুলনা জেলায় সবচেয়ে বেশি অভিবাসনের ঘটনা ঘটতে পারে। অনুমান করা হচ্ছে, এ অঞ্চলগুলো থেকে প্রতি বছর ১৫ থেকে ৩০ হাজার লোক অভিবাসন করবে।"
প্রতি বছর শহরে আগত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং নতুন নতুন বস্তি তৈরি হচ্ছে। কখনো কখনো তাদের এলাকার নামে বস্তি গড়ে তোলা হচ্ছে। যেমন, সন্দ্বীপ দ্বীপ থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষ নিয়ে গড়ে উঠেছে হাটহাজারীর সন্দ্বীপ পাড়া।
ইন্টার্নাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার অনুসারে, জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগ যেমন গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে এক মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, যেখানে শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড় প্রতি বছর ১ লাখ ১০ হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে।
নগরীতে আশ্রয় নেওয়া এসব উদ্বাস্তুরা বারবার উচ্ছেদ, মানবপাচার, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ ও মাদকসাক্ত হওয়াসহ নানাবিধ সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছে। শুধু এখানে নয়, নগরের ১৮টি বস্তিতে বসবাস করছেন আরও কয়েক হাজার মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিৎ এসব মানুষদের অধিকার নিশ্চিতে এখনই আইন প্রনয়ণ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আন্তজার্তিক ফোরামে বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থীদের ভয়াবহতা ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে, না হয় ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।