কড়াইল বস্তি: ঢাকার ভেতর এ যেন এক অন্য শহর!
আসমা আক্তার সরকারি তিতুমীর কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। কড়াইলের অলিগলি দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ফোনের স্ক্রিনে ক্রমাগত টাইপ করছিলেন।
ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে পড়াশোনায় পাশাপাশি আসমা দুটি অনলাইন ফ্যাশন পেজের মডারেটর হিসেবে কাজ করেন। যেখানে নারীদের পোশাক বিশেষ করে শাড়ি বিক্রি করা হয়। এজন্যই মূলত তিনি টাইপিং করছিলেন।
আসমার পরিবার ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকার সবচেয়ে বড় কড়াইল বস্তিতে বসবাস করছে। তার বড় ভাই নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে তাদের পৈতৃক বাড়ি। তবে এই বস্তিতেই আসমা ও তার ছোট বোন রেশমার জন্ম।
আসমা বলেন, "আমি অনেক বছর নোয়াখালী যাইনি। আমাদের বর্ধিত পরিবারে আমিই সবচেয়ে বড় মেয়ে। কিন্তু আমি এখনও বিয়ে করিনি। তাই আমার পরিবারের সদস্যরা এটিকে বেশ বিব্রতকর বলে মনে করেন।"
আসমা ভবিষ্যতে একজন সরকারি কর্মকর্তা হতে চান। বর্তমানে সংসারের খরচ মেটাতে বাবাকে সাহায্য করার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমরা বউবাজার থেকে কড়াইলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। যেখানে বড় বাজারের মোড়ে কদম ফুলের একটি গাছ রয়েছে।
বাজারটিতে সবজি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সবকিছুই পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে রেস্তোরাঁ, কাপড়ের দোকান ইত্যাদি। আসমা জানান, মাঝে মাঝে বনানী থেকেও লোকজন রান্নার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে এখানে আসেন।
কড়াইল বস্তি প্রধানত দুইটি অংশে বিভক্ত। এগুলো জামাইবাজার (ইউনিট ১) ও বউবাজার (ইউনিট ২) নামে পরিচিত। বউবাজারের মধ্যে চারটি ভাগ আছে; এগুলো ক, খ, গ ও ঘ নামে পরিচিত।
এছাড়াও বৃহত্তর কড়াইল বস্তির অধীনে রয়েছে বেলতলা বস্তি, টিএন্ডটি বস্তি, বাইদার বস্তি, এরশাদনগর ও গোডাউন বস্তি। এছাড়াও পশ্চিমপাড়া, পূর্বপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও উত্তরপাড়াও এর অংশ। জমি দখল ও বর্জ্য দিয়ে জলাশয় ভরাট করে বস্তির এলাকাটি ধীরে ধীরে গুলশান লেকের দিকে প্রসারিত হচ্ছে।
লেকসাইডে নির্মিত একটি ঘরের বাসিন্দা শান্তা রানী জানায়, মাটির রাস্তা (লেকের ধারের রাস্তা) সংকীর্ণ হয়ে আসছে। কারণ বস্তির প্রভাবশালী রাজনৈতিক গ্রুপগুলো জমি দখল করছে। টাকার জন্য সেখানে আরও ঘর তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছে।"
কড়াইল বস্তির ৪০ বছর
২০২০ সালের নভেম্বরে আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সানজিদা আহমেদ সিনথিয়া ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ আরবান অ্যান্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ কড়াইল বস্তির উপর একটি কেস স্টাডি প্রকাশ করেছেন।
তার 'এনালাইসিস অব আরবান স্লাম: কেস স্টাডি অন কড়াইল স্লাম, ঢাকা' শীর্ষক গবেষণাপত্রে তিনি বস্তিটির ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন। সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ ও অন্যান্য কাগজপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে ঐ গবেষণায় বলা হয়, ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের শাসনামলে এলাকাটি টেলিগ্রাফ এন্ড টেলিফোন বোর্ড (টিএন্ডটি) বোর্ডের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল।
তখন জায়গাটি ব্যক্তিগত মালিকানায় ছিল। এক্ষেত্রে ক্রয়ের কঠোর শর্তের কারনে জমিটি শুধু টিএন্ডটি ব্যবহার করতো। কিন্তু ১৯৯০ সালে মূল চুক্তির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ৯০ একর জায়গা গণপূর্ত বিভাগকে (পিডব্লিউডি) বরাদ্দ দেওয়া হয়।
যখন পিডব্লিউডি নতুন অধিগ্রহণ করা জমিতে কাজ শুরু করে, তখন মূল মালিকরা চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য টিএন্ডটি-এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়। তারা জমিটি আবারও ব্যক্তিমালিকানায় ফেরতের দাবি জানান।
এক্ষেত্রে আরও আইনি জটিলতা এড়াতে, টিএন্ডটি পিডব্লিউডি-কে দেওয়া ৯০ একর জমি ফেরত নেয়। যদিও জমির আয়তন নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তবে তা ৯০ থেকে ৯৩ কিংবা ১১০ একরের মতো ছিল বলে জানা যায়। একইসাথে তারা পিডব্লিউডির শুরু করা আগের উন্নয়ন কাজকে বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত করে।
এক্ষেত্রে মোটাদাগে আজকের কড়াইল বস্তি এলাকার স্টেকহোল্ডার মূলত তিনটি পক্ষ। যথা, টিএন্ডটি, পিডব্লিউডি এবং জমির প্রাক্তন ব্যক্তিগত মালিক। এদিকে ১৯৯০-এর দশকে টিএন্ডটির স্টাফ, গ্যাং লিডার, গডফাদার ও ওয়ার্ড কমিশনাররা বেআইনিভাবে জমির নানা অংশ দখল করে।
এই দখলকারী ব্যক্তিরা নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষদেরকে কম টাকায় জমি ও ঘর ভাড়া দিতে শুরু করে। এক্ষেত্রে সস্তা আবাসনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলেই আজকের কড়াইল বস্তি তৈরি হয়েছে।
নানা রিপোর্ট অনুযায়ী, কড়াইল বস্তিতে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস করে। এক্ষেত্রে যদি ৯০ একর জমিকে ৮০ হাজার দিয়ে ভাগ করলে দেখা যায়, গড়ে প্রতি ৪৯ বর্গফুট জায়গায় একজন মানুষ বাস করে। যা আবাসনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম স্থানের চেয়েও অনেক কম।
জাতিসংঘের মতে, মৌলিক চাহিদা মেটাতে আবাসনে একজন ব্যক্তির ন্যূনতম ৯৭ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। অন্যদিকে ইউএনএইচসিআর-এর জরুরী আশ্রয়ের মানদণ্ড অনুযায়ী জরুরী পরিস্থিতিতে শরণার্থী শিবিরের মতো স্থানে জনপ্রতি ৩৭.৭ থেকে ৫৯ বর্গফুট জায়গা থাকা উচিত।
এক্ষেত্রে আমরা গুলশান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার ওমর সাদাতের সাথে কড়াইল বস্তির জীবনযাত্রার অবস্থা সম্পর্কে কথা বলেছি। মূলত এই বস্তিটিতেই গুলশান মডেল টাউনের সচ্ছল বাসিন্দাদের বেশিরভাগ গৃহকর্মী, নিরাপত্তারক্ষী ইত্যাদির বসবাস।
এদিকে আমরা ওমর সাদাতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বস্তিবাসীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তারা কোনো দায়িত্ব অনুভব করেন কি না। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমরা অবশ্যই মনে করি যে, তাদের একটি ভালো জীবনযাত্রার প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রথমে বিদ্যমান জায়গায়ই সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা তাদের উচ্ছেদ করার বিষয়ে একমত নই। যদি তারা কড়াইল ছেড়ে চলে যায়, তাহলে আমাদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের একটি উন্নত জীবন প্রদান করা আরও গুরুত্বপূর্ণ।"
বস্তিতে লোকেরা কোথা থেকে আসে?
আসমার বাবা আজমল মিয়া ১৯৯০-এর দশকে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। তখন তার বিয়েও হয়নি।
তেজগাঁওয়ে সংবাদপত্রের হকার হিসেবে কাজ করার সময় আজমল এমন একটি জায়গার কথা জানতে পেরেছিলেন যেখানে সস্তায় খাবার পাওয়া যায়। একইসাথে সেখানে যে কেউ কিছু জমি দখল করে বাড়ি তৈরি করতে পারে।
১৯৯৬ সালে আজমল জুলেখাকে বিয়ে করেন। এরপর ১৯৯৮ সালে তিনি স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
ঐ সময়ের উল্লেখ করে আজমল বলেন, "আমরা মহাখালী ও তেজগাঁওয়ে বেশ কয়েকটা জায়গায় ছিলাম। কিন্তু সেগুলো তখন এতটাই ফাঁকা ছিল যে, জুলেখা একাকী অনুভব করতো। তাই আমি তাকে কড়াইলে নিয়ে আসি যেখানে সারাদেশ থেকে আমাদের মতো মানুষ এসেছিল।" তখন এলাকার বাড়িগুলো কাঠ ও ঢেউটিন দিয়ে তৈরি হতো।
২০০২ সালে আজমল ও জুলেখা কড়াইলে বাড়ি তৈরি করে। ২০১৭ সালের আগুনে পুড়ে যাওয়ার আগে সেখানেই তারা বসবাস করত।
২০০৯ সালে আইসিডিডিআরবি ও ব্রাকের গবেষক দল কড়াইল বস্তির উপর একটি সমীক্ষা চালায়। গবেষণার দেখা যায়, বস্তিবাসীরা বিভিন্ন জেলা থেকে শহরে এসেছিল। এদের মধ্যে প্রথম দিকের বাসিন্দারা কুমিল্লা জেলা থেকে এসেছিল। তাই সেই ক্লাস্টারটিকে 'কুমিল্লা পট্টি' নাম দেওয়া হয়েছে।
সময়ের সাথে সাথে বরিশাল, ভোলা, শেরপুর, বরগুনা, চাঁদপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরসহ অন্যান্য জেলা থেকে লোকজন আসতে শুরু করে। তারা জেলা অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রপ গঠন করতে থাকে এবং কড়াইল বস্তিতে একসাথে বসবাস করতে থাকে।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীরা গ্রামীণ এলাকা থেকে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক এবং নদীভাঙনের মতো পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে ঢাকায় এসে কড়াইলে বসবাস শুরু করে। ২০০৯ সালের ঐ সমীক্ষা আরও দেখা যায়, বস্তিবাসীর প্রায় ৭১ ভাগ গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে রয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বনিন্ম তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৮ বছরের বাসিন্দাও রয়েছে।
আসমা ও তার পরিবার গত ২৬ বছর ধরে বস্তিটিতে বসবাস করছে। আগুনের ঘটনার পর আজমল ঋণ নিয়ে দ্বিতল বাসাটি পুনর্নির্মাণ করেন। যেখানে ভাড়া দেওয়ার জন্য ১৭টি রুম এবং নিজেদের জন্য তিনটি রুম রয়েছে। এক্ষেত্রে ভাড়া থেকে প্রাপ্ত ২৫ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ঋণের সুদ পরিশোধ করেন।
আসমা বলেন, "গত কয়েক বছর ধরে আমার বাবা গুলশান-মহাখালী ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করতেন। কিন্তু দুই মাস আগে পুলিশের উচ্ছেদের ফলে তিনি জায়গাটি হারিয়েছেন। এখন তিনি কড়াইলে একটি ভাতের হোটেল চালুর জন্য আরেকটি ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।"
বর্তমানে পরিবারটি ৪ শতাংশ সুদের হারে একজন মহাজনের থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। আসমা বলেন, "তার (ঋণদাতা) স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং নেতাদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে ঋণের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে তবে তিনি এটিকে বেশ জোরালোভাবে দেখবেন।"
মজার ব্যাপার হল, টাকা ধার দেওয়া এবং জুয়া খেলা দুটোই কড়াইলে বেশ জনপ্রিয়।
মো. আনামুল ইসলাম চৌধুরী একটি ডেলিভারি এজেন্সির সেলস ম্যানেজার। ২০১৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি বনানীতে কাজ করেছিলেন। তার কাজ ছিল ডেলিভারি পর্যবেক্ষণ করা এবং ডেলিভারি কর্মীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা।
আনামুল বলেন, "আমাদের সাথে কাজ করা কড়াইলের যুবকদের সাথে আমাকে যোগাযোগ ও মনিটর করতে হতো। আমার মনে আছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ বা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচের সময় আমরা কখনই তাদের কাছে বড় অর্ডার হস্তান্তর করিনি। কেননা একবার এক ছেলে ৩৫,০০০ টাকা আর ফেরত দেয়নি। কারণ সে টাকা দিয়ে তিনি ক্রিকেট ম্যাচে বাজি ধরেছিল।"
কড়াইল বস্তিতে জমি কেনা যাবে?
কড়াইল জমি কেনা যায় না। তবে এটা সত্য যে, এখানকার জমিগুলো সব সময় অর্থের বিনিময়ে একজন থেকে আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সানজিদা তার গবেষণাপত্রে বলেন, "কড়াইলের বাসিন্দাদের অনেকেই বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ক্রয় করে জায়গার মালিক হয়ে উঠছে। মূলত এসব বিক্রেতারা প্রাথমিকভাবে বেআইনিভাবে জমি দখল করেছিল। এতে মালিকানার সমস্যায় একটি চক্র তৈরি হয় যা বস্তির সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। একইসাথে বস্তিবাসীরা ক্রমাগত উচ্ছেদের উদ্বেগের মধ্যে বসবাস করছে।"
শিপলু লেকের উপর নির্মিত চারটি জরাজীর্ণ অস্থায়ী ঘরের মালিক। পাঁচ বছর আগে তিন লাখ টাকায় তিনি এগুলো কিনেছিলেন।
প্রমাণ হিসেবে তার কাছে ১০০ টাকা মূল্যের একটি স্ট্যাম্প পেপার রয়েছে। যেটিতে উভয় পক্ষের একটি হাতে লেখা স্বাক্ষর রয়েছে। সেখানে লেখা, এই জমি শিপলুকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
শিপলু বলেন, "জমিটি লেকের পাশে হওয়ায় আমি এত কম দামে পেয়েছি। যদি এটা বস্তির মাঝে হতো তাহলে আমাকে প্রায় দ্বিগুণ টাকা দিতে হতো।"
শিপলু ও অন্যদের মতে হ্রদের ধারের জমিগুলো কোনো অভিযান হলে শুরুতেই উচ্ছেদ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি বলেন, "এমনটা অনেকবার হয়েছে যখন পুলিশ ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বাড়িগুলি ভেঙে ফেলার পদক্ষেপ নিয়েছে। তাই এখানে জমির দাম কম।"
বর্তমানে লেকের ধারে ছয় থেকে সাতটি রুম ছয় লাখ টাকায় কেনা যায়। যেখানে একই টাকা দিয়ে বস্তির মাঝখানে তিন থেকে চারটি রুম কেনা যাবে। তবে রুমের আকারের উপর ভিত্তি করে দাম পরিবর্তিত হতে পারে।
মধ্য কড়াইলের বাড়িগুলোর ভাড়া ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়। শর্ত ও সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে তা ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত যেতে পারে। এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইব্রাহিম তার বাবা-মা এবং ভাইয়ের সাথে ৩,৫০০ টাকায় ১৩ ফুট বাই ১৪ ফুটের একটি ঘরে থাকেন।
ইব্রাহিম বলেন, "আমাদের অন্য তিনটি ঘরের নয়জন বাসিন্দাদের সাথে রান্নাঘর ও একটি বাথরুম ভাগ করতে হয়। সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়েই মালিক ১৪ হাজার টাকা আয় করছেন। আমার কলেজের বন্ধু মহাখালীতে থাকেন; যেখানে সে বাথরুমসহ দুই রুমের ফ্ল্যাটের জন্য ১২ হাজার টাকা দেয়। সেক্ষেত্রে কড়াইলে জীবনযাপন বেশ ব্যয়বহুল।"
তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে, তারা কেন এই অবস্থায় বাস করে? কড়াইলের মানুষ বস্তিটি ছাড়ছে না কেন?
এক্ষেত্রে এক বাসিন্দা বলেন, "আশা করি একদিন সরকার বস্তিটি পুনর্বাসন করবে। আমরা একটি সরকারি বাসস্থান পাবো।
যাইহোক, শান্তার মতো মানুষদের জন্য কড়াইলে বসবাস তাদের ভালো আয়ের জন্য কাজ করার সুযোগ দেয়।
শান্তা বলেন, "আমরা যে বাড়িতে কাজ করি তা খুব ধনী। আমার 'ম্যাডাম' আমাকে ঈদের জন্য একটি সুন্দর সালোয়ার-কামিজ দিয়েছেন। এছাড়াও আমার বাসার পাশেই তার বাসা। তাই আমার কাজে যাওয়ার জন্য আমাকে কোনো পরিবহন নিতে হবে না।"
আসমার জন্যও কড়াইলে থাকা বেশ সুবিধাজনক। কারণ সরকারি তিতুমীর কলেজ সেখান থেকে কাছাকাছি এবং তিনি সেখানে বেশ কম খরচে পড়াশোনা করতে পারেন।
আসমা বলেন, "আমার বোন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে জিওলজি এন্ড মাইনিং বিষয়ে পড়াশোনা করছে। ও নিজের খরচ নিজেই চালায়। আমরা আমাদের পড়াশোনা বন্ধ করতে চাই না। তবে এটি আমার বাবা-মায়ের উপর বোঝা হওয়া উচিত নয়।"
কড়াইলের মাঝিরা
গত নয় বছর ধরে গুলশানের সঙ্গে কড়াইল বস্তির সংযোগকারী একমাত্র নৌকা ঘাটটি বন্ধ ছিল। গত ডিসেম্বরে ঘাটটি আবার চালু হয়েছে এবং এটি নারীদের জন্য বেশ সুবিধাজনক হয়েছে।
আখি বলেন, "এটি গুলশান-বনানী লিংক রোডে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। অন্যথায়, লেক পার হতে আমাকে মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে হতো।"
বস্তি থেকে বের হওয়ার দুটি উপায় রয়েছে। একটি, বেলতলা বস্তি হয়ে টিএন্ডটি স্কুল ও ওয়্যারলেস। আরেকটি হল গুলশান লেকের নৌকা ঘাট।
কড়াইলে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক গ্রুপ রয়েছে। এদের মধ্যে রিপন গ্রুপ, জুয়েল গ্রুপ, নুরু গ্রুপ অন্যতম। তারা সবসময় কড়াইল বস্তির বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই করতে থাকে।
এসব দ্বন্দ্ব এমনকি হত্যা পর্যন্ত গড়ায়। গত এক দশকে এই বস্তিতে খুন হয়েছেন ১০ জন।
নৌকা ঘাটের পাশের বাসিন্দা আলামিন বলেন, "নয় বছর আগে এমনই এক সংঘর্ষের কারণে ঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে আমি এখানে নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করতাম। কাজের জন্য বস্তির লোকদের অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি নৌকা চালাতাম। তখন জনপ্রতি ভাড়া ছিল ২ টাকা। এখন নৌকা ভাড়া ১০ টাকা।"
আলামিন ২০০০-এর দশকের শুরুতে কাজের সন্ধানে ভোলা থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি বলেন, "আমি নৌকা আর নদীতে ঘেরা এলাকায় বড় হয়েছি। নৌকা চালানো আমার রক্তে মিশে আছে।"
তবে গুলশান লেকের পানি পিচের মতো কালো। এটি থেকে আসা অসহনীয় দুর্গন্ধে বমি বমি ভাব করে। আলামিনের মতে, বরিশালের অপরুপ নদীগুলো কখনো দুর্গন্ধ ছড়ায় না।
এখানে ২০ জনের বেশি মাঝি কাজ করলেও কেউ নৌকার মালিক নয়। তাদের মালিকের সাথে চুক্তিতে নৌকা নিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
কড়াইলের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র; শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগার
শহীদ রুমি স্মৃতি পাঠাগারটি ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পাশ করা কয়েকজন তরুণ ও বামপন্থী মতাদর্শের মানুষেরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি কড়াইলের পূর্ব পাশে নৌকা ঘাটের পাশে বস্তির একটি ঘরে অবস্থিত। যেখানে এখন প্রায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি বই রয়েছে।
একদল তরুণ শিক্ষার্থী পড়াশোনা, খণ্ডকালীন চাকরি এবং পারিবারিক দায়িত্বের পাশপাশি লাইব্রেরির রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
আসমা দলের সিনিয়রদের একজন। তবে বর্তমানে তিনি খুব একটা সময় দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে ইকবাল, আহসান হাবীব, রবিউল, শালুক ইত্যাদিরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইব্রাহিম বলেন, "কোভিড-১৯ চলাকালীন আমরা বস্তির শিশুদের বিনামূল্যে পড়াশোনা করিয়েছি। এমন দিনও ছিল যখন ৪০ জনেরও বেশি শিশু আমাদের লাইব্রেরিতে পড়তে আসতো। আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের ব্যাচে পড়াতাম। এক্ষেত্রে শুধু একাডেমিক পড়াশোনাই নয়, আমরা স্টাডি সার্কেল তৈরি করেছিলাম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য বস্তিতে তহবিল সংগ্রহ করতাম।"
চলতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এই তরুনেরা একটি প্রচারণার আয়োজন করেছিল। তারা বস্তিবাসীদের মধ্যে আমের চারা বিতরণ করেছে।
২০১৭ সালে কড়াইলে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের শিকার হলে লাইব্রেরিড় তরুণ সদস্যরা প্রতিবাদ করেছিল। ইব্রাহিম বলেন, "আমরা মশাল মিছিল বের করেছিলাম। এমনকি মাইম অ্যাক্টের আয়োজন করেছিলাম।"
কড়াইলের মাইম শিল্পী আহসান হাবীব এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তিনি কলেজ থেকে ফিরে তার বাবার মুদি দোকানে কাজ করেন। অনলাইনে অভিনয় দেখে তিনি মাইম আর্ট শিখেছেন। গভীর কণ্ঠে তিনি আবৃত্তিও করেন।
আহসান হাবীব বলেন, "আমি জানি আমার নামে বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবির নাম রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমি থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স আর্টে পড়তে চাই; আশা করি সেটা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়।"
শচীন মিষ্টান্ন ভান্ডার: কড়াইলের জনপ্রিয় মিষ্টির দোকান
প্রায় ১৭ থেকে ১৮ বছর আগে পুরান ঢাকা থেকে কড়াইলে এসে মিষ্টির দোকান খোলেন শচীন মল্লিক। মূলত নারায়ণগঞ্জের কালীগঞ্জে তার পরিবার বহু বছর ধরে মিষ্টি তৈরি করে আসছে।
শচীনের ভাগ্নে অঙ্কন মল্লিক বলেন, "আমার মামার এক বন্ধু ছিল যে কড়াইলে থাকতেন। এখানে ভালো ছানার মিষ্টির অভাব ছিল। তাই মামা এখানে এসে দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।"
ফার্মের পাশেই বউবাজারে শচীন মিষ্টান্ন ভান্ডারের দোকান। এখন তার ছেলে ও ভাগ্নেরা দোকানের দেখাশোনা করেন। আর শচীন নারায়ণগঞ্জে তার পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করছেন।
অঙ্কন বলেন, "আমাদের ১৩টি গাভী রয়েছে; যা থেকে প্রতিদিন ৯০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। আমরা মিষ্টি তৈরিতে দুধের তিন-চতুর্থাংশ ব্যবহার করি। বাকিটা বিক্রি করা হয়।"
রসগোল্লা ও কালোজাম সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এক কেজি মিষ্টির দাম ২৬০ টাকা। পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর ১৫০ কেজির মতো মিষ্টি বিক্রি হয়।
ইব্রাহিম ও আসমা দুজনই উৎসাহের সাথে জানায়, "যেদিন এসএসসি ও এইচএসসির ফল প্রকাশ হয়, সেদিন দুপুরের আগেই মিষ্টি বিক্রি হয়ে যায়। দুপুর ১২টার পরে আপনি তাকে কিছুই খুঁজে পাবেন না। আমরা এগুলো এতটা ভালোবাসি।"
মমতাময়ী কড়াইলে সামিয়ার শনিবার
সামিয়ার বয়স যখন এক বছর তখন তার বাক ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ত্রুটি ধরা পড়ে। সে একজন ১৩ বছর বয়সির মতো সাধারণভাবে হাঁটতে পারেন না। তার মা ফাতেমা বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন। সেক্ষেত্রে সামিয়াকে তিনি শাশুড়ি ও ভগ্নিপতির কাছে রাখতেন।
২০২০ সালে সামিয়ারা গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে ফিরে যায়। তাই ফাতেমাকে তার চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তার স্বামী একজন ইলেকট্রিশিয়ান ও পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। সেক্ষেত্রে ফাতেমা বাড়িতে থাকতেন এবং তার মেয়ের যত্ন নিতেন।
মমতাময়ী কড়াইল একটি এনজিও প্রকল্প। তারা বৃদ্ধ রোগী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব হসপাইস অ্যান্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ারের (আইএএইচপিসি) অর্থায়নে করা প্রকল্পটি কড়াইলের ২৬ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করে।
সেখানকার পরিচর্যাকারী কড়াইলের বাসিন্দা জাহানারা বেগম বলেন, "প্রতি শনিবার পুষ্টিকর খাবার ও ফিজিওথেরাপি দেওয়ার জন্য আমরা শিশুদেরকে আমাদের কেন্দ্রে নিয়ে আসি।"
ধীরে ধীরে সকাল ১০টায় এই ২৬ জন শিশুকে কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। স্ন্যাকস সেশনের পরে তাদের ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয়। তারপর দুপুরের খাবার দেওয়া হয়। এরপর বিকেল চারটায় মিউজিক, ইন্টারেক্টিভ গেমস এবং অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
ফাতেমা বেগম বলেন, "আমি সামিয়াকে বের হতে দিতে পারি না। কারণ সে ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। তাই শুধু শনিবারেই সে তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে এবং তাদের সাথে খেলার সুযোগ পায়।"
কড়াইলে দুটি ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে। যেখানে শিশুদের কাজের সময় রেখেন যাওয়া হয়। কিন্তু সামিয়ার মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। তাই ফাতেমা বেগম তাকে সেখানে রেখে যেতে পারে না।"
কড়াইলে শহুরে চাষবাদ ও সবুজায়নের গল্প
২০১৭ সালের অগ্নিকাণ্ডে আসমাদের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এটি বস্তির প্রাচীনতম কাঠের ঘরগুলির মধ্যে একটি ছিল। কিন্তু এখন নতুন বাড়িগুলো কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
আসমা বলেন, "আমাদের বাড়ির কাছে একটা লম্বা তালগাছ ছিল। আর একটা বিশাল বটগাছ ছিল আমাদের বউবাজারে; যেটি থেকে ছায়া পাওয়া যেত। এই দুটি গাছই ২০১৭ সালে পুড়ে গিয়েছিল।"
এছাড়াও আসমা চুল আলগা রেখে তাল গাছের নীচে যেতে না দেওয়ার স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, "মা বলতেন, তাহলে আমরা প্রেতাত্মার কবলে পড়তে।"
পুরো এলাকায় সবচেয়ে বড় ছিল বটগাছটি। এর চারপাশে একটি কংক্রিটের কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। এই বটতলা ছিল বস্তির 'সংস্কৃতি কেন্দ্র'।
আসমা ও ইকবাল বলেন, "আমাদের মধ্যে অনেক গায়ক আছেন যারা সাংস্কৃতিক দিবস ও অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে। একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদিতে আমরা নাচ, আবৃত্তি ইত্যাদি করতাম।" ২০১৭ সালের অগ্নিকাণ্ডের পর কড়াইলবাসীর কাছ থেকে বট তলাটিও হারিয়ে গেছে।
বস্তির ৯০ একর জমির মধ্যে অবশিষ্ট পুরাতন গাছের মধ্যে এখনও রয়েছে একটি বেল গাছ। যার নামে বেলতলা বস্তির নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কদম গাছ এবং আরেকটি বটগাছ।
বস্তির লেকের ধারে শান্তা রানী তার টিনের ঘরের পেছনের ছোট্ট জমিতে বেগুন, পালং শাক ইত্যাদি চাষ করছেন।
তিনি বলেন, "রংপুরে আমার বাড়িতে আমাদের একটি সবজি বাগান ছিল। এটি এর চেয়েও সুন্দর ছিল। কিন্তু এটাও বেশ ভালো।"
শান্তা রানী প্রায়শই বউবাজারে পালং শাক এবং ডাটা শাক বিক্রি করেন। সেক্ষেত্রে প্রতি মোটা ৫ থেকে ৬ টাকায় বিক্রি করা হয়।
লেকের ধারে শান্তা রানীর লাগানো কলা গাছে গত মাসে কলা ছিল। তবে সেগুলো তিনি বিক্রি করেননি। বরং তিনি এগুলো তার প্রতিবেশীদের দিয়েছিলেন।