দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের সুফল নেই ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে
ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ ইউনিটের রি-পাওয়ারিং এর পিছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেও মিলছে না সুফল। জানা গেছে, নকশাগত ত্রুটির কারণে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না এই প্রকল্প থেকে।
ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চতুর্থ ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ২০১ মেগাওয়াট থেকে ৪০৯ মেগাওয়াটে উন্নীত লক্ষ্যে ২ হাজার ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে রি-পাওয়ারিং প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।
ইতোমধ্যে, প্রকল্পের ভৌত কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হওয়ার পর প্রি-কমিশনিং টেস্ট শেষে দেখা যায়, উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে মাত্র ৩০ মেগাওয়াট। যদিও নতুন করে এতে যোগ হওয়ার কথা ছিল ১৯৯ মেগাওয়াট।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্পের ডিজাইনে (নকশা) স্টিম টারবাইন অন্তর্ভুক্ত না থাকায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাচ্ছে না। পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান স্টিম টারবাইন পরিবর্তনের বিষয়ে সুপারিশ না করায়, ডিজাইন থেকে তা বাদ দেওয়া হয়।
এখন নতুন করে স্টিম টারবাইন স্থাপন করলে টার্গেট অনুযায়ী এই ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ। তবে, এর জন্য অতিরিক্ত ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্বল পরিকল্পনার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রি-পাওয়ারিং বাবদ যে টাকা খরচ হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে ২০০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াটের নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন (ভূমি অধিগ্রহণসহ) করা সম্ভব।
২১০ মেগাওয়াটের ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট উৎপাদনে আসে ১৯৮৯ সালে। উৎপাদন সক্ষমতা ১৮০ মেগাওয়াটে নেমে যাওয়ায় ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই ইউনিটের রি-পাওয়ারিংয়ের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রকল্পটিতে গ্যাসের চাহিদা মাত্র ৩০ শতাংশ বাড়ালেই উৎপাদন হবে দ্বিগুণেরও বেশি। এতে নির্দিষ্ট জ্বালানি খরচও কমবে ৪৪ শতাংশ।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুসারে, চতুর্থ ইউনিটের রি-পাওয়ারিং বা পুনঃশক্তিকরণের জন্য ২০১৬ সালের জুনে চীনের একটি এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর, চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি) প্রায় ২৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন টারবাইন মডেল ইনস্টল করে। সে সময় থেকে সিম্পল সাইকেল মোডে চলছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
প্রকল্পের অধীনে, ইপিসি ঠিকাদার একটি নতুন গ্যাস টারবাইন, একটি জেনারেটর, একটি হিট রিকভারি স্টিম জেনারেটর এবং অন্যান্য সহায়ক জিনিসপত্র সরবরাহ করেছে। তবে বিদ্যমান ২১০ মেগাওয়াটের এই টারবাইনটি ব্যবহৃত হয় কম্বাইন্ড সাইকেলের ক্ষেত্রে। প্রকল্পের প্রি-কমিশনিং কাজ শেষে, কম্বাইন্ড স্টিম টারবাইনটি রোলিং মোডে রাখা হয় এবং প্রতি মিনিটে এটি ৩ হাজার রেভল্যুশনে পৌঁছায়; কিন্তু উচ্চ শ্যাফট কম্পনের কারণে টারবাইনটি সর্বপরি সিঙ্ক্রোনাইজ করতে ব্যর্থ হয়।
২০২০ সালের ২৩ জুলাই টারবাইনটি সিঙ্ক্রোনাইজ করা হলেও উচ্চ শ্যাফট কম্পনের কারণে এটি বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যবেক্ষণের পর, একই বছর ৯ অক্টোবর আবারও কমিশনিংয়ের কাজ চালু করে ইপিসি। কিন্তু কম্পন তখনও বেশিই ছিল।
প্রকল্পের কম্বাইন্ড সাইকেলের প্রি-কমিশনিং কাজ শেষ হওয়ার পর, বিদ্যামান স্টিম টারবাইনকে রোলিং মোডে দেওয়া হলে শ্যাফট ভাইব্রেশন বা কম্পন বেশি থাকার কারণে স্টিম টারবাইন বন্ধ হয়ে যায়।
এতে দেখা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২৪০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, ১৬৯ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইপিসি চুক্তিতে স্টিম টারবাইনের কোনো কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। স্টিম টারবাইনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে না।
এ অবস্থায়, কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রকল্প সংশোধন করে 'রেকটিফিকেশন ওয়ার্কস অফ এক্সিস্টিং স্টিম টারবাইন অ্যান্ড স্পেয়ার পার্টস অ্যান্ড কনজিউমেবলস আইটেম অফ জিটি আন্ডার এলটিসিএ (লং টার্ম সার্ভিস আর্গুমেন্ট)'- এর দুটি নতুন অঙ্গ যোগ করা হচ্ছে।
২০১৬ সালে যখন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীতে দুই বছর মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় বাড়িয়ে ২ হাজার ৭২ কোটি করা হয়। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ আবারও এক বছর বাড়ানো হয়।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা।
নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে প্রকল্পের ব্যয় ৯৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২ হাজার ১৭১ কোটি টাকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে, মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে দেড় বছর।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান জানান, কম্পনের কারণে এই কেন্দ্রের স্টিম টারবাইনের সঙ্গে এখনো সিঙ্ক্রোনাইজ করা যায়নি। এ কারণে এখন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও সিঙ্ক্রোনাইজ হয়ে গেলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হবে।
কেনো স্টিম টারবাইনের কাজ ইপিসি চুক্তিতে ছিলনা এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রকল্পের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সম্ভাব্যতা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে স্টিম টারবাইন প্রতিস্থাপনের বিষয়ে পরামর্শ না দেওয়ায় এটি প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা হয়নি।
কিন্তু এখন ভৌত কাজ শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে গিয়ে স্টিম টারবাইনের ত্রুটি ধরা পড়ে। এটি স্থাপন ছাড়া কাঙ্খিত ক্যাপাসিটি অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই হয় ২০১২ সালে, তখন বিদ্যমান স্টিম টারবাইনের ব্যবহৃত বয়স ছিল ২৩ বছর। কিন্তু এখন এই মেশিনের ব্যবহৃত বয়স দাঁড়িয়েছে ৩৩ বছর।
সাধারণত যেকোনো মেশিনারিজের ব্যবহৃত বয়স কাল মাত্র ২৫ বছর। স্বাভাবিক কারণেই বিদ্যমান স্টিম টারবাইনটি থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে নতুন একটি স্টিম টারবাইন প্রতিস্থাপন হলে, বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কাঙ্ক্ষিত ক্যাপাসিটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। এরজন্য অতিরিক্ত ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা দরকার হবে বলে জানান তিনি।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো সম্ভব্যতা সমীক্ষা যথাযথ হয়নি। এ কারণে কী কী যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, তা উঠে আসেনি প্রতিবেদনে। তবে প্রকল্পের এই অবস্থায় নতুন করে স্টিম টারবাইনের যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এর দায় ইপিসি ঠিকাদারকে নিতে হবে।
"কারণ ২১০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ৪০৯ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে যা কিছু করার দরকার, তা ঠিকাদারই করবে। তাদের এই ব্যর্থাতার জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের সুযোগ রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের উচিত হবে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া," বলেন তিনি।
এরপর দীর্ঘ সময় ধরে ইপিসি ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনার পর নতুন অঙ্গ প্রকল্পভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে।
বর্তমানে দেশে সরকারি, বেসরকারি ও আমদানি মিলিয়ে ১৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমাতা ২২ হাজার ৫১২ মেগাওয়াট। যদিও বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ১১ হাজার থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট।