ঢাকা উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে কার্যক্রম, আড়তের ব্যবসা
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক কার্যালয়ের ১১ নং কক্ষে বসেন একাউন্টস অফিসার মীর আক্কাস আলী ও তার সহকারী মো. সোহেল। সোহেল মঙ্গলবার সকালে অফিস খুলতেই দেখেন তার কক্ষের ছাদের কিছু অংশের পলেস্তরা খসে মেঝেতে পড়ে আছে, দেখা যাচ্ছিলো ছাদের ভেতরের মরিচা ধরা রডও।
এরপরেও তারা দুজন কক্ষটি পরিস্কার করে ঝুঁকি নিয়েই অফিস করেন।
সোহেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এ ভবনে আমরা অনেকদিন ধরেই ঝুঁকি নিয়ে অফিস করছি। গত কয়েকদিন ধরেই ভবনের বিভিন্ন কক্ষের ছাদের পলেস্তরা খসে পড়ছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা স্যারের কক্ষের ছাদের একাংশ খসে পড়ে। এর পরের দিনই তার সহকারীর কক্ষের ছাদের একটি বড় অংশের আস্তর খসে পড়ে। এতে ছাদের রড বেরিয়ে যায়। তবে এতে কেউ হতাহত হননি।"
সোহেল বলেন, "আমরা এক প্রকার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অফিস করছি। বহু দিন ধরেই শুনছি ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। অফিসে যতক্ষণ থাকি সারাক্ষণই আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়।"
একই ভবনে নিচতলায় রয়েছে সবজি, মশলার আড়ৎ এবং দোতলার বাকি অংশে বস্তার দোকানসহ রয়েছে আবাসিক থাকার জায়গা ও খাবার হোটেল। আঞ্চলিক কার্যালয় ব্যতীত বাকি অংশের অবস্থা আরও ঝুঁকিপূর্ণ। ছাদের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তরা খসে পড়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
কারওয়ান বাজারের কাঁচামালের এ আড়ত ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি অংশেই চলছে ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫–এর আঞ্চলিক কার্যালয়। এর নিচ তলা এবং দোতলার বাকি অংশে আড়ত। আড়তের মালিকরা জানান, পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে তারা নিজস্ব খরচে ভবনের সিলিং মেরামতের কাজ করান।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণার দেওয়ার পরেও এটির মেরামত বা উন্নয়ন নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে আগামী এক মাসের মধ্যেই তারা আঞ্চলিক কার্যালয় সরিয়ে ফেলবে এবং বাকি ব্যবসায়ীদের সরিয়ে ভবনটি খুব তাড়াতাড়িই ভেঙ্গে ফেলবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ২০১৩ সালে এই ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করে। ভবনটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলার সুপারিশ করার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে ভবনগুলোর ভার কমাতেও বলে বুয়েট।
এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের বাজার শাখার তালিকায়ও এই মার্কেট ভবনকে পরিত্যক্ত দেখানো হয়েছে।
তার আগে ২০১০ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) রাজধানীর ৩২১টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে, যে তালিকায় ছিল এ ভবনটিও।
মঙ্গলবার ভবনটি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ভবনের যে অংশে আঞ্চলিক কার্যাললের কাজ চলে সে অংশের ছাদের বেশ কয়েকটি স্থানে পলেস্তরা খসে পড়েছে। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও তার অফিস সহকারীর কক্ষের ছাদের অনেকটুকু অংশ খসে পড়ায় কক্ষ দুটি বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে অফিসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেই বিরাজ করছে আতঙ্ক। এছাড়া এ অফিসে প্রতিদিন সেবা নিতে আসা হাজারো মানুষও থাকছেন আতঙ্কে।
ভবনটির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে দোতলার আঞ্চলিক কার্যালয়ের বাকি অংশ। এ অংশে আছে বস্তার দোকান, দৈনিক কর্মজীবিদের থাকার খুপড়ি ঘরসহ ৭০টির মতো ঘর। যেখানে দোকান ও থাকার কক্ষ আছে তিন শতাধিক।
দোতলায় বসা চায়ের দোকানী রুস্তম আলী টিবিএসকে বলেন, "প্রতিদিনই ছাদের কোনো না কোনো অংশ খসে পড়ে। কোথাও কোথাও কাঠ দিয়ে রেখেছে আবার কাপড় টানিয়ে রেখেছে। এখানে সবসময়ই আতঙ্কে থাকতে হয়, কখন যেন মাথায় ভেঙ্গে পড়ে ছাদ।"
ভবনটির নিচতলাতে আড়তদার মো. ইউসুফ টিবিএসকে বলেন, "অনেকদিন ধরেই শুনছি ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু কার্যক্রম তো বন্ধ হয় না। পেটের দায়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হচ্ছে।"
তিনি জানান, নিচ তলাতে ৬০টির মতো ঘর আছে। যেখানে ৩০০টির মতো দোকান। প্রতিটি দোকানে ২০-২৫ জনের মতো লোক কাজ করে। রাতে এ আড়তে কয়েক হাজার মানুষের আনাগোনা হয়। সবাই ই ঝুঁকিতে থাকে।
আড়তদার মো. হানিফ টিবিএসকে বলেন, "আমরা সমিতির টাকা দিয়ে গত ৫/৬ মাস আগে ছাদ রিপেয়ার করেছি। কখন ভেঙে পড়ে সেই আতঙ্কেই থাকতে হয়। যখন রিপেয়ার করেছে তখন দেখেছি এখানে রডের মান অত্যন্ত নিম্ন মানের, মরিচা ধরা এবং অনেক ফাঁকা ফাঁকা। মার্কেটের পেছনের একটি অংশ গত ২/৩ মাস আগে ভেঙে পড়ে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে এ ভবন।"
আঞ্চলিক শাখার কর্মকর্তারা জানান, গত ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বরের দুর্ঘটনার সময় দাপ্তরিক কাজে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বাইরে ছিলেন। এ দুর্ঘটনায় অন্য কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
ঢাকা উত্তরের অঞ্চল-৫ এর অফিসে প্রায় ৪০০ কর্মকর্তা–কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।
ঢাকা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫ এর নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের অঞ্চলের অফিস এক মাসের মধ্যেই মোহাম্মদপুরে স্থানান্তরিত করবো। এছাড়া পুরো ভবনটিই অল্প সময়ের মধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হবে।"
প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ মাহে আলম টিবিএসকে বলেন, "অঞ্চল-৫ এর অফিস মোহাম্মদপুরের র্যাব-২ এর অফিসের ওখানে চলে যাবে আপাতত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমাদের কথা হয়েছে। অঞ্চল-৫ এর স্থায়ী আঞ্চলিক কার্যালয়ের জন্য মোহাম্মদপুরের টাউন হল কাঁচাবাজার–সংলগ্ন খালি জায়গায় ভবন নির্মাণ করা হবে।"
তিনি আরো বলেন, "যেহেতু এখানে ব্যবসায়ীরা রয়েছেন, সেহেতু হুট করে সরিয়ে ভবন ভাঙ্গা কঠিন কাজ। এরপরেও আমরা অল্প সময়ের মধ্যে তাদেরকে সরিয়ে পুরো ভবনটি ভেঙ্গে ফেলবো।"