ঢাকা- চট্টগ্রাম মালবহনে বড় পরিকল্পনা রেলওয়ের
এক শতাব্দীরও বেশি কাল আগে ব্রিটিশ শাসকদের অধীনে বাংলাদেশের বর্তমান ভুখণ্ডে চালু হয় বাণিজ্যিক রেল যোগাযোগ। উপনিবেশিক সে আমল থেকেই ফ্রেইট ট্রেন বা মালবাহী রেলগাড়ি হয়ে ওঠে সম্পদ পরিবহন ও ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের প্রতীক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে সড়কপথে পরিবহন বাড়তে থাকায় রেলওয়ে হারাতে থাকে তার মালবাহী অংশের বাজার। তাতে অবশ্য রেলপথের আবেদন ফুরায়নি। কারণ রেলপথে মালবহনের মাধ্যমে সাড়া দেশে যত কনটেইনার বহন করা হয় তার ২৫ শতাংশ করার সম্ভাবনা রয়েছে। যা সড়ক থেকে দৈনিক ৫০০ কনটেইনারবাহী ট্রাক অপসারণের সমান।
বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য ও পরিবহনের ধমনী ঢাকা-চট্টগ্রাম রুট। কিন্তু, সক্ষমতার ঘাটতির কারণে এপথে দিনে মাত্র দুটি কনটেইনার ট্রেন চলাচল করছে– যাতে মোট মালবহনের মাত্র ১০ শতাংশ সেবা দিতে পারছে রেলওয়ে।
অবকাঠামোগত এই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে ১৬৮ কোটি ডলারের একটি প্রকল্প নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর মাধ্যমে এই রুটে কনটেইনার বহনের মডাল শেয়ার বাড়ানোর প্রত্যাশা করা হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
বিশ্বব্যাংক আগ্রহ দেখানোর পরই করা হয়েছে প্রকল্পের নকশা। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক দাতাসংস্থাটি এতে ১.০৯ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্পটি শেষ করার সময় ২০৩০ সাল। প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে– ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডরের উন্নয়ন, ঢাকার কমলাপুর রেল ইয়ার্ডের রিমডেলিং, ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনে একটি পরিবহন হাব তৈরি এবং ২০টি মালবাহী লোকোমোটিভ ক্রয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে তারা এই পরিকল্পনা তৈরি করেছেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এতে করে রেলওয়ের আয় বাড়বে, চাপ কমবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। রেলপথে পণ্য পরিবহন সহজ ও কম খরচের হবে'।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সফর করে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তারা এই প্রকল্পে অর্থায়নে তাদের আগ্রহ জানিয়েছেন এবং প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) পাঠাতে বলেছেন।
সেই অনুযায়ী, পরিকল্পনা তৈরির পর নীতিগত অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে, বিশ্ববাংকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পিডিপিপি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগেও ( ইআরডি) পাঠানো হয়েছে।
চলতি বছরের গত ১১-১২ এপ্রিল এবং ৪-৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরে আসে বিশ্বব্যাংকের মিশন। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা প্রকল্পের সাইটগুলি পরিদর্শন করেছেন এবং এবিষয়ে রেলমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
পণ্য বহনকারীদের জন্য রেলপথে পরিবহন– উল্লেখযোগ্যভাবে সস্তা ও দ্রুত একটি বিকল্প। চট্টগ্রাম থেকে পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় আসতে যেখানে ১০-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগে, সেখানে ফ্রেইট ট্রেনে সময় লাগে সাড়ে ১০-১২ ঘন্টা। ট্রাকে পরিবহনের খরচ কনটেইনার প্রতি ২০০-৩০০ ডলার, সেখানে ট্রেনে ভাড়া ১৫০-২৬০ ডলার।
রেলওয়ের সাম্প্রতিকতম তথ্যানুসারে, রেলওয়ের মোট রাজস্বে মাত্র ২১ শতাংশ অবদান রাখছে সারাদেশে চলাচলকারী মালবাহী ট্রেন। প্রতিঘন্টায় সেগুলির গড় গতি কমে দাঁড়িয়েছে ১২ কিলোমিটারে। তবে পাথর, লোহা, ইস্পাত ও খাদ্যশস্য পরিবহনের বড় অংশ রেলওয়ে করছে। আর চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডেল করা কনটেইনারের ১০ শতাংশ বহন করে থাকে।
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ)'র সভাপতি মো. ফজলুল হক মনে করেন, নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশ রেলওয়ের কর্মকর্তারাদের সেবা দেওয়া মানুষিকতাও পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি টিবিএস'কে বলেন, 'লালফিতার দৌরাত্মের কারণে রেল ডিপো থেকে কনটেইনার ছাড় করতে যদি ছয় ঘণ্টা সময় লাগে, তাহলে কোনো ব্যবসায়ী ট্রেন সেবা নিতে যাবে না। পেশাদারিত্ব রক্ষার স্বার্থে মালবাহী সেবা কার্যক্রমকে প্রয়োজনে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে'।
শীর্ষস্থানীয় লজিস্টিক্স বিশেষজ্ঞ এবং এক্সপেডিটরস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। তিনি বাংলাদেশের আমেরিকান চেম্বার অভ কমার্সেরও সভাপতি।
এরশাদ আহমেদ বলেন, রেলে মালবহনের সেবার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক লজিসটিক্স সহায়তাও নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আগে আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত।
তিনি ঢাকা বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর এই দুটি পয়েন্টের মধ্যে রেল যোগাযোগ শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেন।
পরিকল্পনার অঙ্গসমূহ:
রেল করিডোর উন্নয়ন পরিকল্পনার পাঁচটি অঙ্গ রয়েছে। এর মাধ্যমে ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) মিটার-গেজ সেকশনকে ডুয়েল-গেজ ডাবল-ট্র্যাকে রূপান্তর করার মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডোরকে উন্নত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
করিডোরটি বে টার্মিনালকেও রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করবে।
প্রকল্পের অধীনে, কমলাপুর রেল স্টেশনকে বিদ্যমান কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) ৪০.৬ একর বিস্তৃত একটি মাল্টি-মডাল পরিবহন হাব হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
রেল কর্তৃপক্ষ আরও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এবং স্ট্যাকিং সুবিধাসহ কমলাপুর ডিপোকে ধীরাশ্রম স্টেশনে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা করেছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, মাল্টিমডাল হাব মেট্রোরেল, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাই-স্পিড ট্রেন এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কমলাপুর ছাড়াও ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশনকে মাল্টি-মডাল পরিবহন হাবে রূপান্তর করা হবে।
বর্তমানে এই রেল স্টেশনটির সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি পরিবহন প্রকল্প চলছে। এর মধ্যে রয়েছে– ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং টঙ্গী-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
বিমানবন্দর রেলস্টেশনকে একটি মাল্টি-মডাল হাবে পরিণত করা হলে তা এই এলাকায় একটি সমন্বিত পরিবহন সুবিধা বিকাশের সহায়ক হবে।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড রেলপথকে ডুয়েল-গেজ ডাবল-ট্র্যাক লাইনে পরিণত করার জন্য তারা একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করেছেন।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সংযোগকারী রেলপথটির বেশিরভাগই ডাবল লাইনের মিটারগেজ ট্রেনের ট্র্যাক। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে এটিকে মিশ্র-গেজ লাইনে রূপান্তর করছে।
রেল করিডোর প্রকল্পের অধীনে, ২০ মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ, তিনটি অ্যাক্সিডেন্ট রিলিফ ক্রেন এবং তিনটি আন্ডারফ্লোর হুইল লেদ মেশিন কিনতে চায় রেলওয়ে।
লজিস্টিক্স বিশারদ সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, রেলওয়ের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও, সেবা উন্নয়নে নেই কোনো মনোযোগ। প্রবেশ ও নির্গমন উভয় অংশেই ব্যাপক ট্রাফিক জটের কারণে এরমধ্যেই প্রায় ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে উঠেছে কমলাপুর ডিপো। তাই যত শিগগির সম্ভব এটি ধীরাশ্রমে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।