চেক ডিজঅনারের মামলা করতে পারবে না ব্যাংক: হাইকোর্ট
খেলাপী ঋণ আদায়ে জন্য গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যাংক কর্তৃক কোনো চেক ডিজঅনারের মামলা দায়ের করা যাবে না বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ব্যাংক এরকম মামলা দায়ের করলে সেটি সরাসরি খারিজ করতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একইসাথে গ্রাহকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের দায়ের করা এখন পর্যন্ত যতোগুলো চেক ডিজঅনারের মামলা বিভিন্ন আদালতে অনিষ্পন্ন অবস্থায় আছে সেগুলোর কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আদালত।
রায়ে আদালত বলেছেন, ব্যাংক ঋণের বিপরীতে যে চেক নিচ্ছে সেটা জামানত। বিনিময়যোগ্য দলিল নয়। জামানত হিসেবে রাখা সেই চেক দিয়ে চেক ডিজঅনার মামলা করা যাবে না।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের জন্য শুধুমাত্র ২০০৩ সালের অর্থঋণ আইনের বর্ণিত উপায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে পারবে বলে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি হাইকোর্টের রায়ের আলোকে নির্দেশনা জারি করতে দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
ব্র্যাক ব্যাংকের একটি চেক ডিজঅনারের মামলায় মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যক্তির ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং ২ লাখ ৯৫ হাজার ৯০৪ টাকা অর্থদণ্ড হয় বিচারিক আদালতে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে মোহাম্মদ আলীর আপিল নিষ্পত্তি করে বুধবার বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
মোহাম্মদ আলীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আবদুল্লাহ আলী বাকী এবং ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী ছিলেন সাইফুজ্জামান তুহিন।
ব্যাংক চেক ডিজঅনারের মামলা করতে না পারলে, লোন রিকভারি প্রক্রিয়া বেশ বিলম্ব হবে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে ঋণ রিকভারি করা যায়, কিন্তু সেটি অনেক সময়ের ব্যাপার। ব্যাংক চেক ডিজঅনারের মামলা করলে, গ্রাহক সহজেই নেগোসিয়েশনে আসে এবং ঋণ রিকভারির প্রক্রিয়াটি তুলনামূলক কম সময়ে সম্ভব হয়।"
তিনি বলেন, এর আগেই হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ এরকম রায় দিলেও সেটি আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে স্থগিত হয়েছে।
এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আ (রুমী) আলী বলেন, "ব্যাংকগুলো যদি সমস্যায় পড়ে, সেক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আপিল বা রিভিউ করার কোনো ব্যবস্থা থাকলে ব্যাংকগুলোর উচিত সে পথেই এগোনো।"
ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট ইমরান আহম্মেদ ভুঁইয়া বলেন, "ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাহকের কাছ থেকে চেক নেয় সিকিউরিটি হিসেবে। চেক ডিজঅনারের মামলা হয় নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্ট অনুযায়ী।"
ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী সাইফুজ্জামান তুহিন বলেন, "হাইকোর্ট এটি মৌখিক এবং সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেছেন। পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় পাওয়ার বিষয়ে আপিল করা হবে।"
রায়ের পরর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ একটি চুক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়ে থাকে। ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ, অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে, তাদের হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়নে চেকের অপব্যবহার করে মামলা করে থাকে।
আদালত বলেন, ঋণের বিপরীতে ব্ল্যাংক চেক নেওয়াটাই বেআইনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি কাজ করে আসছে।
রায়ে হাইকোর্ট নিম্নআদালতের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে বলেন, আজ থেকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি চেক ডিজঅনার মামলা করে তাহলে আদালত তা সরাসরি খারিজ করে দেবেন। একইসঙ্গে তাদেরকে ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে পাঠিয়ে দেবেন।
আদালত পর্যবেক্ষণে আরো বলেন, "ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল গরিবের বন্ধু, কিন্তু তা না হয়ে ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গরিবের রক্ত চুষে বেড়াচ্ছে। এটা হতে পারে না। যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছে ব্যাংক তাদের ঋণ মওকুফ করার কথা শুনি। কিন্তু কোনো গরিবের ঋণ মওফুফ করার কথা কোনোদিন শুনিনি।"
"নীলকর চাষিদের মতো, দাদন ব্যবসায়ীদের মতো যেনতেন ঋণ আদায় করাই তাদের লক্ষ্য। লোন আদায়ের জন্য অর্থঋণ আইনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মামলা দায়ের না করে চেক ডিজঅনার মামলা করছে। এ কারণে আমাদের ক্রিমিনাল সিস্টেম প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। তাই এখন থেকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। অন্যকোনো আইনে নয়।"