২৫ টাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের খাবার মেলে এমপি’স কিচেনে
সোমবার দুপুর একটা। চট্টগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ পুরাতন চেম্বার ভবনের সামনে মানুষের দীর্ঘ লাইন।
দূর থেকে মনে হবে টিসিবির পণ্যের জন্য মানুষের অপেক্ষা। তবে কাছে যেতেই ভুল ভাঙল। পণ্যের জন্য নয়, দুপুরের খাবারের জন্য দাঁড়িয়েছেন তারা।
গত দুই মাস ধরে দুপুর কিংবা রাতে ২০-৩০ টাকার মধ্যে খাবার খেতে এমপি'স কিচেনের সামনে দেখা যায় নিম্ন আয়ের মানুষের এই লাইন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী এম এ লতিফ গত দুই মাস ধরে শ্রমজীবী মানুষদের জন্য স্বল্পমূল্যে এই খাবারের ব্যবস্থা করছেন। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ২২০০ মানুষ খাবার খান।
এমপি'স কিচেনে সবজি-ডাল-ভাত ২০ টাকা, ডিম-ডাল-ভাত ২৫ টাকা, ডিম-খিচুড়ি ২৫ টাকা, মুরগি ডাল ভাত ৩০ টাকা এবং মাছ ডাল ভাত ৩০ টাকা।
দ্রব্যমূল্যের প্রভাবে হোটেলগুলোতে যখন খাবারের দাম বেড়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস, ঠিক তখনি ২০-৩০ টাকায় একবেলা খাবার খেতে পেরে খুশি শ্রমজীবীরাও।
সোমবার দুপুরে আগ্রাবাদের কিচেনে খাবার খাচ্ছিলেন রিক্সাচালক কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, "এই এলাকায় কোনো হোটেলে ১০০ টাকার নিচে খাবারের চিন্তা করা যায় না। দিনে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করে ২০০ টাকায় দুই বেলা খাবার খেলে সংসার চলবে না।"
"গ্রামে বাবা-মা, বউ-বাচ্চার জন্য টাকা পাঠাতে হয়। তাই কোনদিন দুই বেলা খাওয়া হয় না। কিন্তু কিচেন টা হওয়ার পর এখন ৫০ টাকা দিয়ে দুই বেলা খেতে পারি।"
খাবারের জন্য লাইনে অপেক্ষামাণ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মী আজিজুল হক বলেন, "যা বেতন পাই তা দিয়ে ঘর ভাড়া, পরিবারের খাবার, বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই দুপুরে বেশিরভাগ সময় ১৫-২০ টাকার মধ্যে কলা-পাউরুটি-বন খেতাম। কিন্তু এই কিচেন টা হওয়ার পর ওই টাকা দিয়ে এখন দুপুরের ভাত খেতে পারি।"
এমপি'স কিচেনের ম্যানেজার রাজীব দাশ জানান, অক্টোবর থেকে আগ্রাবাদে `এম পি'স কিচেন চালু হয়। এই কিচেনে প্রতিদিন দুপুরে ১৬০০-১৭০০ জন এবং রাতে ৫০০ জন মানুষ খাবারের ব্যবস্থা হয়। একসঙ্গে ১২০ জন মানুষ ভাত খেতে পারে। চাহিদা বাড়ায় পরিসর আরো বাড়ানো হচ্ছে।
আগ্রাবাদের এমপি'স কিচেনের প্রধান বাবুর্চি আব্দুর রহমান বলেন, "সকাল আটটা থেকে রান্নার প্রক্রিয়া শুরু হয়। চারজন বাবুর্চি বিকেল তিনটা পর্যন্ত রান্নায় ব্যস্ত থাকেন। রান্না, মসলা তৈরি, ধোয়া-মোছা ও খাবার পরিবেশনে ১২ জন লোক কাজ করেন।"
"কম টাকায় মানুষকে পেটভরে খেতে দেখে নিজেরই অনেক ভালো লাগে। দুপুর এবং রাতের জন্য আলাদা আলাদা করে রান্না করা হয়। কোনভাবেই এক বেলার খাবারের সাথে আরেক বেলার খাবার যোগ করা হয় না," বলেন তিনি।
শুধু আগ্রাবাদ নয়, নগরীর সিইপিজেড গেটে ২০১৩ সালে পোশাক কর্মীদের জন্য প্রথম এমপি'স কিচেন চালু করেন এই জনপ্রতিনিধি। যেখানে প্রতিদিন ১৫০০-১৬০০ মানুষ খাবার খায়। এরমধ্যে দুপুরে ১২০০ এবং রাতে খান ৩০০-৪০০ জন।
তবে পোশাকর্মীদের কথা চিন্তা করে আগ্রাবাদের চেয়ে আরো পাঁচ টাকা কম মূল্যে খাবার বিক্রি হয় সিইপিজেডে। অর্থাৎ মাত্র ১৫-২৫ টাকায় সেখানে মেলে একবেলার খাবার।
কিচেনের শুরু যেভাবে
কিচেনের উদ্যোক্তা এম এ লতিফ বলেন, "আমার সংসদীয় আসনটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রথম শ্রেণির ১১টিসহ মোট ২৩ কেপিআই রয়েছে। এরমধ্যে দুই ইপিজিডেই প্রায় দুই লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। ফলে এই এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি।"
"এই মানুষগুলো তাদের পরিবারের ব্যয় মিটিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে গেলে কষ্ট হয়। তারা যা আয় করেন তার বেশির ভাগ চলে যায় ঘর ভাড়া, খাবার ও পরিবারের ভরণ পোষণে। এসব লোকগুলো তাদের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারে না। অনেকে কর্মক্ষেত্রে না খেয়ে দিন যাপন করে,"
"এসব শ্রমজীবী মানুষের কথা চিন্তা করে ২০১৩ সালে সিইপিজেড গেটে প্রথম কিচেন চালু করি। এরপর গত মাসে আগ্রাবাদে আরেকটি কিচেন চালু করি," বলেন তিনি।
ব্যবসা থেকে ভর্তুকি
আগ্রাবাদ এবং সিইপিজেড দুটি কিচেনে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার মানুষের খাবারের জন্য কমপক্ষে ১০-১২ বস্তা চাল, এক হাজার পিস ডিম, ২০০ কেজি মুরগি, ৮০ কেজি রুই মাছ ও ৬০ কেজি সবজি প্রয়োজন হয়।
এসব খাবারে দিনে ২৭ হাজার টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। এছাড়া গ্যাস সিলিন্ডারে লাগে ৯ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতন ও দোকান ভাড়াসহ দুটি কিচেনে প্রতিমাসে ভর্তুকি প্রায় ১৩ লাখ টাকা।
পারিবারিক ব্যবসার লাভ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই অর্থ ব্যয় হয় বলে জানান এম এ লতিফ।
শিপিং ও আবাসন খাতে ব্যবসা রয়েছে এম এ লতিফের। ছিলেন চিটাগাং চেম্বার অব কর্মাস ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি। ২০০৮ সাল থেকে তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম-১০ আসন থেকে।
চালু হচ্ছে নতুন শাখা
আগামী জানুয়ারিতে এমপি'স কিচেনের আরো একটি শাখা হচ্ছে নগরীর পুরাতন রেল স্টেশন এলাকায়। স্টেশনের ভ্রাম্যমাণ লোক, রেয়াজুদ্দিন বাজার, ফলমন্ডী ও কদমতলী বাস স্টেশনের শ্রমিকদের সুবিধার্থে এই কিচেন চালু করা হচ্ছে বলে জানান এম এ লতিফ।
এছাড়া ফকির হাট এলাকায় প্রস্তুত হচ্ছে একটি সেন্ট্রাল কিচেন। যেখানে প্রতিদিন দুপুরের খাবারসহ নাস্তা তৈরি হবে। এসব নাস্তা বিক্রি হবে বাজারের অন্যান্য পণ্যের চেয়ে অর্ধেক দামে। যা বিপণন করবে 'স্বাধীনতা নারী শক্তি' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী নারী সংগঠন।
এর আগে ২০১৩ সাল থেকে করোনার আগ পর্যন্ত নগরীর জনবহুল এলাকাগুলোতে ভ্যানে করে ভর্তুকি মূল্যে লাঞ্চ বক্স বিক্রি করতো এমপি'স কিচেন। করোনার সময় থেকে ভ্যানে লাঞ্চ বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
এছাড়া নগরীর ১০টি ওয়ার্ডে পিকাপে করে ভর্তুকি মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য বিক্রি করেন এম এ লতিফ। যেখানে বাজার মূল্যের চেয়ে ৪০-৫০ শতাংশ কম মূল্যে পণ্য বিক্রি হয়।