১০ মিনিটেই চিকিৎসাসেবা, বিনামূল্যে: আলো ক্লিনিকে
ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন আসমা বেগম ও তার স্বামী। চিকিৎসকের দেখা পেতে তাদের সময় লাগল মাত্র দশ মিনিট।
যে দেশে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে রোগীদের ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়, সেখানে এটি বেশ বড় ব্যাপার। তবে এটি এখানকার ব্যতিক্রমী নয়, নিয়মিত ঘটনা।
কোনো বিখ্যাত, বড় হাসপাতাল এরকম দ্রুত সেবা দিচ্ছে না। এমন সেবা দিচ্ছে রাজধানীর কড়াইল বস্তি এলাকায় গড়ে ওঠা আলো ক্লিনিক।
নামের মতোই ক্লিনিকটি বস্তি এলাকার ১ লাখ ৪০ হাজার এবং আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য আশার আলো হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া হচ্ছে তাদের। যদিও প্রথমে ক্লিনিকটির সেবা দেওয়ার কথা ছিল বস্তির ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার বাসিন্দাকে।
বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয় বলে এই ক্লিনিকটি রোগীদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়।
এখানে শুধু রোগীদের সময়ই বাঁচে না, তাদের চিকিৎসাব্যয়ও বেঁচে যায়।
সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একজন প্রতিবেদক কড়াইল বস্তিতে দোতলাবিশিষ্ট আলো ক্লিনিক পরিদর্শনে যান। সেখানেই দেখা মেলে আসমার।
ক্লিনিকের দোতলায় আসমা ও তার মতো অন্য রোগীরা নাম নিবন্ধন করিয়ে সিরিয়াল নম্বর নেন।
একটু এগোলেই ক্লিনিক সহকারীর টেবিল। ওখানে রোগীরা নিজেদের বিস্তারিত ব্যক্তিগত তথ্য দেয়। এরপরই প্যারামেডিকের রুমে। সেখানে রোগীদের ওজন ও তাপমাত্রা নেওয়া হয় এবং তাদের অক্সিজেনের মাত্রা, রক্তচাপ এবং ব্লাড শুগার পরীক্ষা করা হয়।
এর পর রোগীরা ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে।
আসমা বেগম ও তার স্বামী বিল্লাল হোসেনও এই সবগুলো ধাপ অতিক্রম করেছেন। বিল্লাল পেশায় অটোরিকশা চালক।
কড়াইল বস্তির জামাই বাজার এলাকার বাসিন্দা বিল্লাল সোমবার রাত থেকে পেটব্যথায় ভুগছিলেন।
ডাক্তার দেখানো শেষ হলে দুজনকে বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হলো।
ডাক্তার দেখানো শেষে দুজনেই আগের চেয়ে আশাবাদী হয়ে চেম্বার থেকে বের হলেন, বেশিরভাগ পরিবারের জন্যই যা বড় স্বস্তির ব্যাপার।
আসমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগে আমরা ওষুধ কিনতাম, ডাক্তারের ফি-ও দিতাম। কিন্তু এখন আমরা দুটোই বিনামূল্যে পাচ্ছি। আমিও অসুস্থ হলে এখানেই আসি। কয়েকদিন আগে আমার বড় মেয়ের ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা হয়েছে এখানে।'
আলো ক্লিনিক হলো শহরের বাসিন্দাদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য দুই বছরের পাইলট প্রকল্প। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে সুইডিশ সিডা, প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। আলো ক্লিনিকের এই মডেলটিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরবান হেলথ কেয়ারের আওতায় নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
কড়াইল বস্তি ছাড়াও মিরপুরের দুয়ারীপাড়া, শ্যামপুর শিল্পাঞ্চল, যাত্রাবাড়ীর ধলপুর, টঙ্গীর এরশাদ নগর ও নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে আলো ক্লিনিক রয়েছে। প্রত্যেক ক্লিনিক ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার মানুষকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।
শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিনগুলো ছাড়া প্রতিদিনই আলো ক্লিনিকের সেবাগুলো দেওয়া হয়। সেবা দেওয়া হয় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট এবং বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
এই ক্লিনিকে রোগীরা প্রসবপূর্ব ও প্রসবোত্তর পরিচর্যা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, ইপিআই টিকাদান এবং ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও অসংক্রামক রোগের চিকিৎসাসহ সব ধরনের মৌসুমী রোগের চিকিৎসা পায়।
সাধারণ রোগের ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, স্যালাইন, জিঙ্ক, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধসহ তেইশ ধরনের ওষুধ এখানে বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
সিবিসি, ক্রিয়েটিনিন, ইসিসি, ডেঙ্গু ও ডায়াবেটিসসহ দশটি পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয়।
আলো ক্লিনিকে রোগীর রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে প্রেসক্রিপশন, পরীক্ষার রিপোর্টসহ প্রতিটি ধাপই কম্পিউটারাইজড। একবার একজন রোগী রেজিস্টার্ড হয়ে গেলে ডাক্তাররা ফলো-আপ বা ভবিষ্যতের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করার জন্য তাদের পূর্ববর্তী চিকিৎসার তথ্য দেখতে পারেন অনায়াসে।
আলো ক্লিনিকে একজন রোগীকে ডাক্তাররা সাধারণত ৮ থেকে ১০ মিনিট সময় নিয়ে দেখেন।
ডাক্তারদের তৈরি সমস্ত প্রেসক্রিপশন একটি ক্লাউড সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। প্রেসক্রিপশন নিরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসাকর্মীদের একটি দল আছে যারা দৈব চয়নের মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন বাছাই করে সেটির গুণগত মান পরীক্ষা করেন। এরপর তারা চিকিৎসকদের পরামর্শ দেন।
ক্লিনিকে দুজন পুরুষ ও দুজন নারী এমবিবিএস চিকিৎসক রয়েছেন। প্রতি শিফটে একজন নারী ও একজন পুরুষ চিকিৎসক থাকেন। দুজন প্যারামেডিক ও একজন নার্সসহ চৌদ্দজন কর্মী এখানে কাজ করেন।
দেশে ক্রমবর্ধমান শহুরে জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে অসংক্রামক রোগসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। কিন্তু শহরগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র না থাকায় টারশিয়ারি ও সেকেন্ডারি কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার চাপ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে আলো ক্লিনিকের মডেলটি গ্রহণের সুপারিশ করেছেন যা বিভিন্ন দেশের নগর স্বাস্থ্যসেবা মডেল মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে।
বস্তির বাসিন্দাদের পাশাপাশি বাইরের মানুষও আসেন সেবা নিতে
ক্লিনিক ইনচার্জ তৌহিদুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, কড়াইল আলো ক্লিনিক চালু হয় ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর।
শুরুতে রোগীর উপস্থিতি কম থাকলেও এখন প্রতি শিফটে ৯০ জনের বেশি রোগী ক্লিনিকে আসে।
বস্তি এলাকায় অবস্থিত হলেও কড়াইল আলো ক্লিনিক আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে উঠেছে।
কড়াইল বস্তির পাশে অবস্থিত টিঅ্যান্ডটি কোয়ার্টারে বসবাসকারী অনেক সচ্ছল মানুষ ক্লিনিকে আসেন জানিয়ে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'তারা মূলত স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসেন, ক্লিনিক কোথায় সেটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। যেসব রোগীকে এখানে চিকিৎসা দেওয়া যায় না, তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়। যে হাসপাতালে রোগীদের রেফার করা হয়, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো আনুষ্ঠানিক এমওইউ নেই—তবে রোগীদের ঠিকমতো যত্ন নেওয়া নিশ্চিত করার জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ আছে।'
বনানী এলাকা থেকেও অনেক রোগী কড়াইল আলো ক্লিনিকে আসেন বলে জানালেন ক্লিনিকের জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা. মোহসিনা করিম।
তৌহিদুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, নভেম্বর মাসে কড়াইলের আলো ক্লিনিকে ১ হাজার ১৮১ জন পুরুষ, ২ হাজার ৫৯৬ জন নারী, দুজন ট্রান্সজেন্ডার ও ৮৫৫ জন পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু সেবা নিয়েছে।
এ ক্লিনিকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর ডে-কেয়ার সেবা দেয়ার জন্য দুটি শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। শিগগিরই এই সেবাপ্রদান শুরু হবে।
ডা. মোহসিনা করিম বলেন, ইদানীং ডেঙ্গু রোগী বেশি আসছে। এছাড়া ত্বকের সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, ব্যাক পেইন, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, গর্ভবতী মা, মৌসুমি সব রোগীই তারা পান।
'আমরা চেষ্টা করি রোগীর কথা মন দিয়ে শোনার, ফ্রেন্ডলি আচরণ করার। বনানী থেকেও কিছু রোগী আসে এখানে,' বলেন তিনি।
ক্লিনিকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি 'স্যাটেলাইট ক্লিনিক' নামে একটি গাড়ি সপ্তাহে তিন দিন বস্তিতে ঘুরে ঘুরে রোগীদের স্ক্রিনিং করে এবং প্রয়োজনে আলো ক্লিনিকে পাঠায়।
সেবা নেওয়ার পর মতামত জানাতে হয়
ডাক্তার দেখানো শেষে ওষুধ বা টেস্টের স্যাম্পল দেয়ার পর টোকেন জমা দেওয়ার আগে রোগীকে বাটন টিপে ইমোজির মাধ্যমে সন্তুষ্টি বুথে মতামত জানাতে হয়।
লাল ইমোজি দেওয়ার অর্থ হলো রোগী সেবা নিয়ে অসন্তুষ্ট। রোগীর সামনে স্ক্রিনে তখন ছয়টি প্রশ্ন আসে। সেখানে সেবা পেতে অনেক সময় লেগেছে, ক্লিনিক অপরিষ্কার, মানসম্মত সেবা পাননি, সেবাদাতার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট কি না—এমন সব প্রশ্ন আসে।
সেখান থেকে সমস্যা জানালে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষনিক তা জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।
আলো ক্লিনিককে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেওয়ার পরামর্শ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ টিবিএসকে বলেন, আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার নিয়ে সরকারের হাতে কোনো মডেল নেই।
আলো ক্লিনিক মডেলটি নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আলো ছড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে নেওয়া উচিত।
'ক্লিনিকটি এখন যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেভাবেই পরিচালনা করতে হবে। তাহলে শহরের মানুষের চিকিৎসা সেবা নিতে আউট-অভ-পকেট ব্যয় অনেক কমে যাবে এবং সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে,' বলেন তিনি।
ইউনিসেফের সূত্র জানায়, প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের (পিএইচসি) জন্য মাথাপিছু বিনিয়োগ হবে ১ হাজার টাকা বা ১০ ডলার, আর প্রতিটি আলো ক্লিনিকের পেছনে বছরে খরচ হবে ৩ কোটি টাকা।
ইউনিসেফের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীর টিবিএসকে বলেন, আলো ক্লিনিক একজন মানুষকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
আলো ক্লিনিক প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত চলবে। এর আগে ইউনিসেফের স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট (স্ক্যানু) নামে একটি পাইলট প্রকল্প ছিল। সেই প্রকল্পটি স্বাস্থ্য নিয়ে নেওয়ার পর এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে স্ক্যানু চালু করা হয়েছে। সেরকম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আলো ক্লিনিক প্রকল্পটিও নিয়ে নিলে শহরের মানুষদের বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সেবা দিতে পারবে।
মারগুব আরেফ বলেন, আলো ক্লিনিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য একটি প্রদর্শনী প্রকল্প।
ছয়টি ক্লিনিক পরিষেবা সরবরাহের বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলার পক্ষে সংখ্যায় একেবারেই কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তবে সরকার এই প্রকল্পের পরিসর বাড়ালে এর উদ্দেশ্য হাসিল হবে।'
আলো ক্লিনিক প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারপারসন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আহমেদুল কবির টিবিএসকে বলেন, নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে দায়িত্বটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে ন্যস্ত।
'সে কারণে আলো ক্লিনিক মডেলটি স্কেল আপ করার চিন্তা আছে। আলো ক্লিনিক নিয়ে শিগগিরই আমাদের মিটিং আছে,' বলেন তিনি।
আলো ক্লিনিক সরকারের আওতায় এলে সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার খরচ কেমন হবে জানতে চাইলে আহমেদুল কবির বলেন, 'প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের দায়িত্ব সরকারের। সরকার তো ফ্রিতেই প্রাইমারি হেলথ কেয়ার দিচ্ছে। আলো ক্লিনিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় এলে সেটির পরিধি আরও বাড়বে।'