মৌসুমেও পাহাড়ে নেই পর্যটক, লোকসানের শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা
পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই রাঙ্গামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের দুটি হোটেল ও পাঁচটি কটেজের সবকটি অন্তত তিনমাসের জন্য বুকিং হয়ে যায়। কিন্তু মৌসুম শুরুর আড়াইমাস পরেও ৬০ শতাংশ রুম খালি পড়ে আছে। শহরের হোটেল-মোটেলগুলোতে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েও মিলছেনা পর্যটক।
শুধু রাঙ্গামাটি নয়, রূপময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত তিন পার্বত্য জেলায়ই পর্যটকদের আনাগোনা কমেছে উদ্বেগজনকভাবে। লোকসানের আশঙ্কায় আছেন তিন জেলার প্রায় আড়াই হাজার ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, সীমান্তে উত্তেজনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে এমনটা ঘটছে।
শুক্রবার বিজয় দিবসের দিনে সরেজমিনে দেখা যায়, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেকের উপর ঝুলন্ত সেতু, পর্যটকবাহী বোট, ঐতিহ্যবাহী টেক্সটাইল মার্কেটের অনেকটাই ফাঁকা। পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সে হাতে গোনা কয়েকজন দর্শনার্থী বেড়াতে এসেছেন।
একই পরিস্থিতি জেলা পুলিশ পরিচালিত পলওয়েল পার্ক ও জেলা প্রশাসন পরিচালিত ডিসি পার্কে। ভিড় ছিলো না কাপ্তাই লেক তীরবর্তী মনোরম শহীদ মিনার এলাকাতেও।
পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পাঁচটি কটেজসহ আমাদের ৮৮টি রুমে আবাসন সুবিধা রয়েছে। চলতি ডিসেম্বরে ৬০ শতাংশ রুমই খালি থাকছে। নভেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ ছিলো, সে মাসে মাত্র ২২ শতাংশ রুম বুকিং নিয়েছিলেন পর্যটকরা।'
রাঙ্গামাটির ঐতিহ্যবাহী টেক্সটাইল মার্কেট পাহাড়িদের হাতে বোনা তাঁতের কাপড় ও বিভিন্ন তৈজসপত্রের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু শনিবার মার্কেট ছিলো অনেকাংশেই ফাঁকা। দোকানিদের অনেককেই অলস সময় কাটাতে দেখা যায়।
বনানী টেক্সটাইলের স্বত্বাধিকারী মোতালেব হোসেন বলেন, 'অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী- এই পাঁচ মাসকে সামনে রেখে আমরা সারা বছর কাপড় তৈরী করি। কিন্তু এবছর পর্যটন মৌসুমের আড়াই মাস চলে গেলেও পর্যটকের দেখা নেই। শ্রমিকদের মজুরিই উঠছে না; লাভ তো অনেক দূর।'
হোটেল স্কয়ার পার্কের স্বত্বাধিকারী নিয়াজ আহম্মেদ বলেন, 'আমার হোটেলে ২০০ অতিথির আবাসন সুবিধা রয়েছে। গত বছর এই সময়ে দম ফেলার ফুসরত পাইনি। অথচ লাভ তো দূরে থাক; এবার ১৬ ডিসেম্বর আমার নিট ক্ষতি ছিলে ২০ হাজার টাকা।'
তিনি বলেন, 'মূলত মানুষের পকেটে টাকা নেই। এছাড়া পাহাড়ের বাইরে থেকে আসা মানুষের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়াকড়ি আরোপ করেছে।'
কাপ্তাই হ্রদের বুকে ভেসে বেড়ানো প্রমোদতরী 'মাউরুন হাউজবোট' পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার উচ্ছল চাকমা টিবিএসকে বলেন, 'পরিস্থিতি খুবই খারাপ। নভেম্বরে আমরা মাত্র একটা ট্রিপ পেয়েছিলাম। যদিও স্বাভাবিক সময়ে অন্তত দশটি ট্রিপ আমরা পেয়ে থাকি।'
'মূলত বান্দরবানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার প্রভাবটা রাঙ্গামাটিতেও পড়েছে। দর্শনার্থীরা পাহাড়ে আসছেন না', বলেন উচ্ছল চাকমা।
গত ৯ অক্টোবর থেকে বান্দরবানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমন্বিত জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করে। অভিযান চলাকালে নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে ১৭ অক্টোবর থেকে পর্যটক ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় চার উপজেলায়। ফলে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে বান্দরবান। বিজয়ের মাসে ছুটি উপভোগ করতে ১৩ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬০ শতাংশ ছাড় ঘোষণা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত দর্শনার্থী পায়নি বিনোদন কেন্দ্রগুলো।
নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, অন্যান্য বছর বিজয় দিবসে ৪ হাজারের বেশি পর্যটকের আগমন ঘটতো। কিন্তু এবছর মাত্র ১২০০ দর্শনার্থী নীলাচল ভ্রমণ করেছেন। একই পরিস্থিতি জেলার আরেক বিনোদন কেন্দ্র মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের। এদিন মাত্র ১১০০ পর্যটক এসেছিলেন মেঘলায়।
বান্দরবান হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি অমল কান্তি দাশ টিবিএসকে বলেন, 'পর্যটকদের ভ্রমণে আগ্রহী করতে পর্যটননির্ভর তিনটি সংগঠন সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ মূল্যছাড় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবুও গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না।'
তিনি জানান, রেস্তোরাঁর কর্মচারীসহ এই খাতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান বান্দরবানে। এর মধ্যে সরাসরি সম্পৃক্ত আবাসিক হোটেলগুলোতে প্রায় ২ হাজার ৫০০, যানবাহনে ১ হাজার ২০০, রেস্তোরাঁয় ১ হাজার ৫০০ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এছাড়া কমিউনিটি পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকশ পরিবারের আয় কমেছে।
আলুটিলা, রিছাং ঝরনা, তৈদুছড়া, ঝুলন্ত ব্রিজ, শিলাছড়ি, মায়াবিনী লেকসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন খাগড়াছড়ি। এছাড়া রাঙ্গামাটির সাজেক যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে।
খাগড়াছড়ি পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক এ কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, 'পাহাড়ের মধ্যে খাগড়াছড়ি পর্যটনে অনেক পিছিয়ে। তাই পর্যটকের সংখ্যা কমছে। জেলায় পর্যটন স্পটগুলো আধুনিকায়ন করা হয়নি দীর্ঘ সময়। সেগুলো দ্রুত সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার।'
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক বলেন, 'পার্বত্য এলাকার পর্যটনে নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য ট্যুরিস্ট পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ কাজ করছে। এতে পর্যটকদের ভয়ের কিছু নেই।'
এদিকে মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনার কারণে সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের জন্য ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জাহাজ চলাচলের অনুমতি মিলেনি।'
ট্যুর অপারেটস এসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি আনোয়ার কামাল বলেন, 'সেন্টমার্টিন ঘিরেই কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসা আবর্তিত। বিগত ২০ বছর ধরে এই চিত্র দেখা আসছি। কিন্তু এবার সীমান্তে উত্তেজনার কারণে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল শুরু হয়নি, যা পর্যটন ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে।'