নিজস্ব টহলবোট নেই, চোরাচালান বিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না চট্টগ্রাম কাস্টমস
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের নিজস্ব টহলবোট না থাকায় নিয়মিত চোরাচালানবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না সংস্থাটি। ফলে চোরাচালান, অবৈধ মালামাল পাচারের পাশাপাশি রাজস্ব বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দুটি টহল বোট দীর্ঘ এক যুগ বিকল থাকার পর চার মাস আগে বাতিল ঘোষণা করেছে সংস্থাটি। দীর্ঘ সময়েও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিজস্ব নৌযান যুক্ত না করে বিকল থাকা বোট দুটি নিলামে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
কাস্টমসের কর্মকর্তারা বলছেন, নিজস্ব নৌযান না থাকায় নিয়মিত চোরাচালানবিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে পারছেন না। কোন ধরনের চোরাকারবারির তথ্য পেলে স্পিডবোট বা টাগবোট ভাড়া করে অভিযান পরিচালনা করতে হয়। এছাড়া শিপিং এজেন্টদের ব্যবস্থাপনায় টাগবোট দিয়ে বন্দরের বহির্নোঙ্গরে তদারকি করা হয়।
কাস্টমস হাউসের তথ্যমতে, সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যানবাহন ও অফিস সরঞ্জামাদি অকেজো সংক্রান্ত কমিটি চলতি বছরের ২৫ জুলাই 'সফেন' ও 'সমীক্ষা' নামে দুটি টহলবোট বাতিল ঘোষণা করে। নৌযান দুটি নিলামে বিক্রি করতে গত ২২ নভেম্বর জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজগুলোর মাধ্যমে যেন চোরাচালান কার্যক্রম সংঘটিত না হয়- তা তদারকিতে নিয়োজিত রয়েছে কাস্টমস হাউসের 'রামেজ ডিভিশন' ও 'এফ ডিভিশন'। এই দুটি ডিভিশনের নিয়মিত অভিযান বা টহল পরিচালনার জন্য ১৯৮৫ সালে ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন নৌযান কেনা হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা এলাকার ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামের একটি প্রতিষ্ঠান 'সফেন' ও 'সমীক্ষা' নামে টহলবোট দুটি তৈরি করেছিল। নৌযান দুটির দৈর্ঘ্য ২৯ দশমিক ৮৬ মিটার ও প্রস্থ ৬ মিটার। আর ড্রাফট ২ দশমিক ৯ মিটার। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২০১১ সাল থেকেই অচল হয়ে পড়ে আছে নৌযান দুটি। এগুলো সচল করতে এবং নৌযান রাখার জেটি (পন্টুন জেটি) মেরামতের জন্য ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। এরপরও নৌযান দুটি সারানো যায়নি।
নিয়মিত অভিযান পরিচালনা না করায় চোরাকারবারের শঙ্কা বাড়ছে। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থানার বিমানবন্দর সড়ক থেকে ২ হাজার ৭৫ লিটার চোরাই জ্বালানি তেলসহ দু'জনকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। ওই সময় র্যাব জানিয়েছিল, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আসা বিদেশি জাহাজ থেকে ডিজেল, অকটেন ও মবিলসহ জ্বালানি তেলগুলো সংগ্রহ করে একটি চক্র। মূলত শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সেই তেল দেশের বাজারে সরবরাহ করে তারা।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা থানাধীন ১৩ নম্বর ঘাটের উত্তর লালদিয়ার চর এলাকা থেকে 'এমভি তানিশা' নামের একটি লাইটারেজ জাহাজ থেকে ১১ হাজার লিটার অপরিশোধিত ভোজ্যতেল উদ্ধার করেছিল নৌপুলিশ। বিদেশ থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের মাদার ভেসেলের অসাধু কিছু মাস্টার, সুকানি ও কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজসে তেলপাচার কারবার সংঘঠিত হয়েছিল। জাহাজে থাকা নাবিক এবং অন্য স্টাফদের জন্য খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জাহাজে পৌঁছে দেয়ার নাম করে সমুদ্রে ভাসমান জাহাজ থেকে নামানো হতো এসব তেল। পরে তা লাইটারেজ জাহাজে করে এনে কম দামে বিক্রি করা হতো খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন তেলের আড়তে। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর মোহনায় একই জাহাজ থেকে ১৩ হাজার লিটার তেল জব্দ করে কোস্টগার্ড পূর্ব জোন।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত 'এমভি বাও ইউ' নামে বিদেশি জাহাজে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ডলারের বিনিময়ে খাদ্যদ্রব্য, গ্যাস সিলিন্ডার ও মোবাইল সিম কার্ড পাচারে যুক্ত ছয় ব্যক্তিসহ একটি স্পিডবোট জব্দ করেছিল টহলরত কোস্টগার্ড। সেখান থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের বিদেশি মুদ্রা, ৬৪০ লিটার ডিজেল, ১ হাজার শলাকা বিদেশি সিগারেট, ৭টি মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়েছিল।
নিজস্ব নৌযান না থাকায় নিয়মিত চোরাচালানবিরোধী অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রামেজ ও এফ ডিভিশনের দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার মহিউদ্দিন পাটোয়ারী। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "নিজস্ব বোট থাকলে আমরা অভিযান জোরদার করতে পারতাম। প্রয়োজনমতো যেকোন সময় মুভ করতে পারতাম।"
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার (মুখপাত্র) মোহাম্মদ মাহফুজ আলম বলেন, "দীর্ঘদিন অজেকো থাকার পর বোট দুটি বাতিল করা হয়েছে। এগুলো বিক্রি হয়ে গেলে নতুন করে বোট কেনার জন্য বাজেট করা হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে কেনা হবে।"