দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এই সীমাহীন উন্মাদনা কেন, বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা কী?
'আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স দল বিশ্বের সব ফুটবলপ্রেমীকে একটি অপূর্ব সুন্দর প্রতিযোগিতামূলক ও উপভোগ্য খেলা উপহার দিয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষই এ খেলা উপভোগ করেছে। আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন। পৃথিবীর কেবল দুটি দেশের রাজধানী নগরী, আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস এবং বাংলাদেশের ঢাকা, খেলা শেষে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে, স্থানীয় সময় যথাক্রমে বিকাল তিনটায় ও রাত বারোটায়।
'আগে থেকেই বিশ্বকাপ খেলা উপলক্ষে আর্জেন্টিনাকে (এবং ব্রাজিল) নিয়ে আলোচনায় বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশকে নিয়েও সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, হোক না বিশ্বের ফুটবল র্যাঙ্কিং-এ বাংলাদেশের স্থান ১৯২তম। আমার জানামতে বিদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশিদের এই ফুটবল প্রেম নিয়ে ইতিমধ্যেই গবেষণা শুরু করেছেন। খোদ আর্জেন্টিনাতেও বাংলাদেশকে নিয়ে এক ধরনের মজার চমক তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকের মতে, এ থেকে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হবার সম্ভাবনাও আছে। উপযুক্ত নেতৃত্বে বাংলাদেশিদের এই নির্দোষ আবেগ-উচ্ছ্বাস সমাজ মেরামতের কাজেও লাগতে পারে।
'বাংলাদেশে এরই মধ্যে ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে দশজনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এক দলের সাপোর্টার অন্য দলের সাপোর্টারকে মেরেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। আর ফেসবুকে ট্রল, বিদ্বেষ তো চলছেই।'
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সোমবার রাত ১টায় ফেসুবকে এ স্ট্যাটাস দেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে দেশে মারা গেছে দশজনের বেশি মানুষ। ফাইনাল ম্যাচকে কেন্দ্র করে সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া সাতক্ষীরার গাবুরায় আর্জেন্টিনা সমর্থকরা ৩ হাজার মানুষের জন্য ভূরিভোজের আয়োজন করেছেন। ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিজয় উদযাপন করার সময় সিলেটে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন একজন। তার স্ট্যাটাসের সূত্র ধরেই বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা, তার সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। সেজন্য টিবিএস কথা বলেছে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও একজন সমাজবিজ্ঞানীর সঙ্গে।
মানুষের আবেগের বহিঃপ্রকাশের সমস্যার কারণে খেলা নিয়ে উম্মাদনা, ট্রল বেশি
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
খেলায় উত্তেজনা, উন্মাদনা থাকবে, কিন্তু খেলা নিয়ে আমরা যে আবেগটা দেখাই তা নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে। ইমোশনাল কোয়াশিয়েন্ট (আবেগাঙ্ক) যখন মাত্রাতিরিক্ত বা মাত্রার চেয়ে কম হয় তখন যেকোনো বিষয়ে মানুষ তার আবেগের সুষম প্রকাশ করতে পারে না।
মানুষের আবেগের বহিপ্রকাশ যদি সুষম না হয় তাহলে শুধু ফটবল নিয়ে নয়, যেকোনো বিষয় নিয়ে উন্মাদনা, আবেগের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ, ট্রল করা, উত্তেজনা, আগ্রাসন এমনকি অন্যকে হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটে। এটি হলো মানুষের আবেগের বহিঃপ্রকাশের দুর্বলতা।
আবেগের বহিঃপ্রকাশে দুর্বলতার কারণ শৈশবে আবেগের বিকাশকে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশি সেটি বেশি। কারণ আমাদের দেশে আবেগকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
আমরা শারীরিক বিকাশকে গুরুত্ব দেই। শিশু লম্বা হচ্ছে কি না, খাচ্ছে কি না, কথা বলছে কি না তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ছোটবেলায় একটা মেয়ে যখন জোরে জোরে হাসে তখন আমরা বলি মেয়েদের এত জোরে হাসতে নেই। একটা ছেলে যখন কাঁদে তখন আমরা বলি—'তুমি মেয়ে নাকি যে কাঁদছ?'
এভাবে আমরা ছোটবেলা থেকেই আবেগের বিকাশকে অবদমিত করি। এই অবদমিত আবেগের বিকাশ ভবিষ্যতে আবেগের বহিঃপ্রকাশের সমস্যা তৈরি করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবজারভেনশনাল লার্নিং। এখন মানুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অন্যের রিকগনেশন চায়। বিশেষ করে ট্রল করে বেশি লাইক, কমেন্ট চায়। তার নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে অন্যের স্বীকৃতি চায়।
শুধু খেলা নয়, আবেগের বহিঃপ্রকাশের সমস্যার কারণে পারিবারিক সহিংসতা, সামাজিক সহিংসতা, রাস্তাঘাটে মানুষের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তাই আবেগের বহিঃপ্রকাশকে শৈশব থেকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদেরও অন্যের আবেগকে গুরুত্ব দিতে হবে। আরেকজনের আনন্দে আনন্দিত বা দুঃখে দুঃখ পাই কি না দেখতে হবে। আবেগের বহিঃপ্রকাশ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।
দেশে কালচারাল অ্যাক্টিভিটির অভাবে মানুষ বিশ্বকাপ নিয়ে অতিরঞ্জিত আচরণ করে
ড. এ এস এম আমানুল্লাহ, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বকাপের সময় এটি একটি ইউনিভার্সেল ফেনোমেনা দুটি বিরোধী দলের মধ্যে। কিন্তু আমরা একটু বেশি করি। আমাদের মতো অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান বা আফ্রিকান দেশগুলোও করে না।
বাংলাদেশে এত অতিরিক্ত করার কারণ আমাদের তরুণদের বিনোদনের (রিক্রিয়েশনের) তেমন কোনো ব্যবস্থা আমরা করতে পারি না। এটি জাতীয় পর্যায়ের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা।
আমাদের দেশে ষাট, সত্তর ও আশির দশক পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের কালচারাল মুভমেন্ট ছিলো। দেয়াল পত্রিকা বের করা হতো, সাহিত্য নিয়ে সভা-সেমিনার হতো, কবিতা পাঠের আসর ছিল, এক ধরনের আড্ডার কালচার ছিলো বাংলাদেশে। কিন্তু গত দুই দশকে এটি একদম হারিয়ে গেছে।
ফলে আমাদের তরুণ গ্রুপদের হইচই আনন্দ করার কোনো সুযোগ নেই। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় বা পাড়া-মহল্লায়ও সে চর্চা নেই। না থাকার পেছনে কারণ হলো র্যাপিড আরবানাইজেশন, র্যাপিড গ্লোবালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ভেতরে আমরা ঢুকে গেছি। মানুষের মেধা-মনন তৈরিতে কালচারাল মুভমেন্ট হচ্ছে না।
আমরা শুধু টাকা টাকা টাকা করছি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিস্তার হচ্ছে, তারা অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে উন্নয়ন করছে। সে কারণে যখন এমন একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট হয় যেটাতে তারা রিক্রিয়েশন পাবে, আড্ডা দিতে পারবে, সবাই মিলে দেখতে পারবে, হইচই করতে পারবে সেটিকে তারা সিরিয়াসলি নেয়। তখন তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা-ট্রল ডেভেলপ করে, আরেকজনকে আন্ডারমাইন করার মনোভাব ডেভেলপ করে।
যেসব দেশ বিশ্বকাপ খেলে, যেমন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলেও এমন উত্তেজনা, উন্মাদনা কাজ করে না। আরেকটি বিষয় হলো, যে জাতি ডেভেলপ করে তারা ইকোনোমিক, স্যোসাল বিভিন্ন ধরনের পলিসি নেয়। আমাদের দেশে স্যোসাল পলিসি একেবারে ইগনোরড। এত বড় ইয়ুথ গ্রুপকে নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে কোনো পলিসি নেই। স্যোসাল পলিসি লেভেলের মাধ্যমে কম্পিটিটিভ ইয়ুথ গ্রুপ তৈরি করা যায়, যারা খেলা দেখবে কিন্ত অতিরিক্ত কিছু করবে না। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে এটি হচ্ছেনা।
কালচারাল রেভোল্যুশন, সোসিওলাইজেশন, মূল্যবোধ, পারিবারিক পরিবেশের মাধ্যমে অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই আক্রমণাত্মক আচরণ শুধু খেলার ক্ষেত্রে থাকে না, অন্যান্য ক্ষেত্রেও করবে। এ সমস্যাটা চিহ্নিত করে উত্তর আমেরিকার দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া, চীন সাংস্কৃতিক বিপ্লব করেছে। সেখানকার বাচ্চারা ছোটবেলা থেকে বোঝে কোনটা করা যাবে কোনটা করা যাবে না। এজন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, বিনিয়োগ ও পলিসি সাপোর্ট লাগবে। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে, খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে। মানুষকে ট্রেনিং দিয়ে মানুষ বানাতে হয়। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।