১৮ বছরের অপেক্ষা শেষে চালু হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল
২০০৫ সালে প্রনয়ণ করা 'স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান' এ চিহ্নিত মেট্রোরেল বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে বাস্তবতার মুখ দেখছে আগামী ২৮ ডিসেম্বর। এইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা উদ্বোধন করবেন। এর মাধ্যমে শেষ হতে যাচ্ছে রাজধানীবাসীর দীর্ঘ ১৮ বছরের অপেক্ষা। ভারতীয় উপমহাদেশের তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হতে যাচ্ছে উড়াল মেট্রোরেল।
আধুনিক পদ্ধতিতে টিকিট কিনে এর পরের দিন থেকেই অত্যাধুনিক এই পরিবহন ব্যবহার করতে পারবেন ঢাকাবাসী। উড়াল পথের এই মেট্রোরেলে চড়তে হলে তিন তলায় স্থাপিত প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে যাত্রীদের। এর আগে দোতলা থেকে কিনতে হবে যাত্রার টিকিট। মেট্রোরেলে চড়ে গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছানোর পর আবার টিকিট ব্যবহার করেই ত্যাগ করতে হবে প্ল্যাটফর্ম।
সচরাচর বিদেশে ভ্রমণ করা ব্যক্তিদের মেট্রোরেলে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও ঢাকা মেট্রোর সম্ভাব্য যাত্রীদের অধিকাংশের এমন অভিজ্ঞতা নেই। তাই এমআরটি লাইন-৬ এর ১১ কিলোমিটার লাইনে সেবা চালুর আগে মেট্রোরেল স্টেশনে প্রবেশ করা থেকে শুরু করে টিকিট কেনা, স্টেশন এলাকা ও ট্রেনে অবস্থান এবং স্টেশন থেকে বের হওয়ার নিয়ামবলী জনসাধারণকে জানাতে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা জারি করেছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিক কোম্পনি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। উত্তরা থেকে যাত্রা শুরু করে আগারগাঁও এসে থামবে, এরমাঝে আর কোথাও বিরতি দেবে না ট্রেন। স্টেশনে ট্রেন থেমে থাকবে ১০ মিনিট। এছাড়া, সপ্তাহে একদিন মঙ্গলবার বন্ধ থাকবে চলাচল।
মেট্রো স্টেশন এলাকায় কী ধরনের কাজ অবশ্যই করতে হবে, কী কাজ একেবারেই করা যাবে না, আবার কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে- এ ব্যাপারেও প্রচারণা চালাচ্ছে ডিএমটিসিএল।
টিকিটিং ব্যবস্থা
প্রতি কিলোমিটার পাঁচ টাকা আর সর্বনিম্ন ২০ টাকা ধরে ইতোমধ্যেই মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। সিঙ্গেল জার্নি টিকিট বা একক যাত্রা টিকিট এবং এমআরটি পাস ব্যবহার করে ভাড়া পরিশোধের মাধ্যমে মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করা যাবে।
লাইনে দাড়িয়ে টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) হতে যাত্রীরা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেও সিঙ্গেল জার্নি টিকিট কিনতে পারবেন। আবার যারা এই মেশিন ব্যবহার করতে পারবেন না তারা টিকিট অফিস মেশিন (টিওএম) হতে বিক্রয়কারীর সহায়তায় কিনতে পারবেন টিকিট। এই দুই জায়গা থেকে একসঙ্গে সর্বোচ্চ পাঁচজনের টিকিট কেনা যাবে।
এমআরটি ধারীরা তাদের পাস পেইড জোনের প্রবেশ পথে থাকা নির্দিষ্ট স্ক্যানারে স্ক্যান করে প্ল্যাটফর্মে যেতে পারবেন। গন্তব্য স্টেশনে নেমে আবারও কার্ড স্ক্যান করে তারা স্টেশনের বাইরে আসলে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া কেটে নেবে কর্তৃপক্ষ।
সিঙ্গেল জার্নির টিকিটের ক্ষেত্রেও এমআরটি পাসের মতই একটি কার্ড দেওয়া হবে। এই কার্ড পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করার পর গন্তব্য স্টেশনে নির্দিষ্ট স্লটে তা রাখলেই বহির্গমন পথ উন্মুক্ত হবে।
এমআরটি পাসের সুবিধা ও পাওয়ার উপায়
মেট্রোরেল সেবা চালু হওয়ার দিন থেকেই নির্দিষ্ট পরিমাণে ফি দিয়ে প্রতিটি স্টেশনে এমআরটি পাস পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক। তিনি জানিয়েছেন, সর্বনিম্ন ২০০ টাকা পরিশোধ করে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে এই কার্ড কেনা যাবে। ৫০ টাকা জামানত হিসেবে রেখে এই কার্ডে স্থিতি থাকা সাপেক্ষে যেকোনো পরিমাণ মূল্যের ভ্রমণ করা যাবে। এই কার্ডে সর্বোচ্চ ব্যালেন্স রাখা যাবে ১০ হাজার টাকা।
তিনি আরও জানান, এই কার্ড থাকলে টিকিটের জন্য লাইন ধরা লাগবে না। তাছাড়া টিকিট ভেন্ডিং মেশিন ব্যবহার করে এই কার্ড রিচার্জ করা যাবে। মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমেও এমআরটি পাস টপ-আপ করার সুযোগ পর্যায়ক্রমে যুক্ত হবে বলে জানান তিনি।
মেট্রোরেলে যা নিষিদ্ধ
মেট্রোট্রেন, প্ল্যাটফর্ম এবং পুরো স্টেশন এলাকা ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ, মেট্রোরেলে ভ্রমণের সময় যাত্রীরা ধূমপান করতে পারবেন না। তাছাড়া, প্ল্যাটফর্ম ও স্টেশনে যেকোনো ধরনের পানাহার (খাওয়া-দাওয়া) নিষিদ্ধ থাকবে। পান খাওয়া, যেখানে-সেখানে পানের পিক ফেলাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া মেট্রো স্টেশনে থুথু বা কোনো ধরনের ময়লা ফেলা যাবে না।
মেট্রো রেলে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ থাকছে যে কোনো ধরনের পণ্য ফেরি করা। আগ্নেয়াস্ত্র বহন, পোষা প্রাণী বহন, বিপজ্জনক পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি নিষিদ্ধ থাকবে ভারী ও বড় আকারের মালামাল পরিবহনও।
মেট্রোরেলে নারীদের কোচে পুরুষ যাত্রীদের ওঠাও নিষিদ্ধ থাকবে। একইসঙ্গে প্রতিটি কোচে থাকা বয়ষ্ক এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সিটেও অন্যরা বসতে পারবে না। একাধিক সিট দখল করে বসাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ড্রাইভিং ক্যাবে ঢোকা যাবে না। দুই কোচের মাঝখানে চলাচলের পথে দাঁড়ানোও যাবে না।
সার্বিক বিবেচনায় স্টেশনের সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে পোস্টার, ব্যানার ও দেয়াল লিখনও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অবশ্যই পালনীয়
মেট্রোরেলের টিকিট কাউন্টার এবং প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনে ওঠার ক্ষেত্রে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। স্টেশনে ট্রেন বেশি সময় দাঁড়ায় না বিবেচনায় আগে যাত্রীদের নামতে দিয়ে পরে উঠতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো একটি ট্রেন চলে গেলে পরের ট্রেনের জন্য আরও সাড়ে তিন মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।
নিরাপত্তা কর্মী ও টিকিট চেকারদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে হবে যাত্রীদের। চাওয়ামাত্র দেখাতে এমআরটি পাস বা সিঙ্গেল জার্নির টিকেট সঙ্গে রাখতে হবে।
যেকোনো প্রয়োজনে স্টেশন কন্ট্রোলারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে যাত্রীদের। মনোযোগ দিয়ে ট্রেনের ও স্টেশনের সবগুলো ঘোষণা শুনতে হবে।
থাকতে হবে সতর্ক
মেট্রো ট্রেনের কোচের প্রবেশ পথে কোনো কিছু আটকে থাকলে দরজা বন্ধ হয় না। এই বিবেচনায় দরজায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির বিষয়ে যাত্রীদের সতর্ক থাকতে বলেছে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। এছাড়া নিরাপত্তার স্বার্থে প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর দিয়ে ঢোকা মেট্রো রেল দেখার বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে যাত্রীদের।
প্রতিটি ট্রেনেই রিয়েলটাইম লোকেশান ম্যাপ থাকবে। এই ম্যাপ ব্যবহার করে পরবর্তী স্টেশন ও গন্তব্যের দুরত্ব সম্পর্কে জানতে যাত্রীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্ল্যাটফর্ম থেকে সামান্য দুরত্বে একই উচ্চতায় এসে দাঁড়াবে মেট্রো ট্রেন। প্ল্যাটফর্ম ও কোচের দুরত্ব সম্পর্কে সতর্ক থাকতেও পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সতর্কতার অংশ হিসেবে ট্রেনে ওঠা ও নামার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে অন্য যাত্রীদের অসুবিধা বিবেচনায় স্পিকার অন করে মোবাইলে কথা না বলারও পরার্মশ দেওয়া হয়েছে।
স্টেশন, কোচসহ মেট্রেো রেলের প্রতিটি অবকাঠামো ও এলাকায় সার্বক্ষণিক সিসিটিভি রয়েছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মালিকবিহীন কোনো মালামাল পাওয়া গেলে এ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি নিজের মালামাল সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতেও পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।