ঢাকার মেট্রোরেলের প্রথম দিনের ‘পরাবাস্তব’ অভিজ্ঞতা
উত্তরার বাসিন্দা মধ্যবয়স্কা গৃহিণী সাথী আক্তার। বৃহস্পতিবারের সকালটি তার কাছে ছিল অন্যরকম অনুভূতির। কারণ, এদিনই নাগরিকদের জন্য যাত্রী পরিষেবা চালু করেছে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল।
এই অনন্য অভিজ্ঞতা লাভ করতে দিয়াবাড়ি স্টেশনে মেয়েদের নিয়ে সেজেগুজে হাজির হয়েছেন সাথী আক্তার। লাইনে দাঁড়িয়ে দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষার পর অবশেষে চাপেন স্বপ্নের লোকোমোটিভে।
মেট্রোরেলের ট্রেনের বগিতে ছিল যথেষ্ট সংখ্যক আসন। কিন্তু, উত্তেজনায় বসতেই পারছিলেন না সাথী ও তার কন্যারা। নাচানাচি না করলেও, অভিব্যক্তিতে ছিল উত্তেজনার স্পষ্ট ছাপ।
আগারগাঁও অভিমুখে ট্রেন ছাড়তেই, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এগোল সামনে। এসময় কোনো হাতলগুলো ধরে কোনোক্রমে ভারসাম্য রক্ষা করে পরিবারটি। কিন্তু, এতে যেন তাদের উচ্ছ্বাস আরও বাড়লো।
'বহুদিন অপেক্ষা করেছি এ দিনের সাক্ষী হতে। জীবনে প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলের যাত্রা এটা আমাদের। তাই আমরা ভীষণ খুশি'- কাছে গিয়ে আলাপচারিতা শুরু করতেই জানালেন সাথী।
আরও বললেন, 'পরিবারকে নিয়ে এসেছি, মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি।'
একই ধরনের আনন্দের আঁচ লক্ষ করা গেল অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যেও। আর তা হওয়ারই কথা, কারণ তাদের মেট্রোরেলের স্বপ্ন যে এবার সত্যি হয়েছে।
তখন আমি আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ি গিয়ে আবার আসছিলাম ফিরতি যাত্রায়। আগারগাঁও আসতে সময় লাগে মাত্র ১২ মিনিট।
ট্রেন থেকে নামতেই পরিবারসহ সাথী আক্তারকে ঘিরে ধরেছিলেন সাংবাদিকরা, তাদের কন্ঠ তখন আরও উচ্চকিত।
সাংবাদিকদের ক্যামেরা তো ছিলই, সঙ্গে অনেকে মোবাইলেও ধারণ করছিলেন উদযাপনের এই মুহূর্তকে।
তাদেরই একজন ইয়ামাদা নামের একজন জাপানি ভদ্রলোক। তার পোশাক ও আইডি কার্ড দেখেই বুঝলাম তিনি কাজ করেন মেট্রোরেল প্রকল্পে। এবার তার কাছেই জানতে চাইলাম অনুভূতির কথা।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি উচ্চারণে ইয়ামাদা যা জানালেন, তার অর্থ দাঁড়ায়– 'মানুষের এই আনন্দ, উচ্ছ্বাস– সুন্দর এক দৃশ্য। তাদের এই আনন্দ মনে দাগ কেটেছে।'
২০১৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর পর মিরপুরসহ যেসব পথের ওপর মেট্রোরেলের লাইন নির্মিত হয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে চলাচলে। কয়েক বছর ধরে এই নির্মাণকাজের জন্য রাস্তার পরিধি কমায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে দুঃসহ যানজট। নির্মাণকাজের এই ঝঞ্ঝাট অবশ্য এখনো শেষ হয়নি।
তবে ট্রেনে চড়া মাত্রই এসব দুর্ভোগের কথাটা যেন উবে যায় মাথা থেকে। নিওন সবুজ রঙা আসন, রেল কামরার আলো, আর চারপাশের ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন পরিবেশকে রঙিন লাগছিল। এক কথায় বলা যায়, যেন 'ভিন্ন এক জগতে ঢুকে পড়েছি।'
ট্রেন যখন উত্তরা রওনা হয়- তখন একটু একটু করে ঘোর কাটতে শুরু করেছিল। বুঝতে পারছিলাম, এটা বাস্তব।
এই অভিজ্ঞতা কী অতিরঞ্জন! মোটেও হয়তো নয়, কারণ আমাদের রাজধানীবাসী প্রতিনিয়ত পথ চলতে মুখোমুখি হতে হয় যানবাহনের বিকট শব্দের, আর ময়লা তো যত্রতত্র। কিন্তু, নিওন আলোর নিচে দাঁড়িয়ে সে অভিজ্ঞতাকে যেন দূর বাস্তবতা মনে হতে থাকে।
দ্রুতগতির মেট্রো ট্রেনে খোশগল্পে মশগুল ছিলেন দুই সহকর্মী–লিপন ও রাফিদ, আর তখনই তাদের সাথে আমিও যোগ দিলাম।
লিপন বললেন, 'মনে হচ্ছে, আমরা দুজনেই আজকে এই ট্রেনের প্রথম অফিসযাত্রী। আমরা থাকি আগারগাঁও, আর অফিস মিরপুর ডিওএইচএসে। অফিসের গাড়ি না থাকলে নিজদের মোটরকারে অফিস যাই। কিন্তু, আজ মেট্রোরেল সেবা চালুর প্রথম দিন হওয়ায়, ট্রেনে করেই অফিস যাব বলে ঠিক করি।'
'আমরা গর্বিত, এটা অনন্য এক অভিজ্ঞতা।' ভবিষ্যতে মাঝেমধ্যেই মেট্রোরেলে অফিস যাওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানালেন।
দিয়াবাড়ি যাওয়ার সময় মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত ভারতীয় কর্মকর্তা সতিন্দর কুমারের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি বললেন, 'আমি আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের দেখাশোনার কাজ করি। কিন্তু, আজ এই অংশের দেখভালের কাজটা করছি। মানুষকে এভাবে আনন্দ করতে দেখে দারুণ লাগছে।'
'আমরা যখন ভারতে প্রথম মেট্রোরেল চালু করি, তখন মানুষের ভিড় আর আগ্রহ ছিল আরও বেশি। আমি বলব এখানকার মানুষেরা বরং বেশ সুশৃঙ্খল,' সতিন্দর বলেন।
তবে মানুষ যে একেবারেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না, তাও নয়।
যেমনটা আগে বলেছি, নির্মাণযজ্ঞের যন্ত্রণা অনেক বেশি ভোগ করেছিলেন মিরপুরের বাসিন্দারা। মিরপুরের কমপক্ষে পাঁচজনের সঙ্গে দেখা হলো যারা অফিস ছুটি নিয়েছেন বা দোকানপাট বন্ধ করে চলে এসেছেন মেট্রোরেলে প্রথমবার চড়ার জন্য।
মিরপুর ১২'র বাসিন্দা আসাদুজ্জামান কাজ থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন মেট্রোয় চড়তে। 'এটা আমাদের জন্য একটা পরাবাস্তবতার দিন। কাজটা শেষ বলে বিশ্বাসই হচ্ছে না।'
আগারগাঁও স্টেশনে দিয়াবাড়ির জন্য ফিরতি টিকিটের অপেক্ষা করছিলেন রহিমা বেগম। তার সঙ্গী পুরুষ যাত্রীটি টিকিট কিনছিলেন, আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে তিনি অপেক্ষারত। উত্তরা থেকে সপরিবারে মেট্রোরেলে চড়তে এসেছেন বলে জানান রহিমা বেগম।
তবে পরাবাস্তবতার এ প্রথমদিনে সবকিছু একেবারে নির্ঝঞ্ঝাটে কাটেনি।
কাউন্টারে টিকিট বিক্রির স্বল্পগতি, ভেন্ডিং মেশিনে ত্রুটি, দীর্ঘমেয়াদী এমআরটি পাস ইস্যু করায় ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দিয়াবাড়ি ও আগারগাঁও; উভয় স্টেশনেই যাত্রীদের দীর্ঘ অপেক্ষার সারি তৈরি হয়েছিল।
দিয়াবাড়ি স্টেশনে টিকিট কাটছিলেন মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, 'আমি তাদেরকে অনেকবার অনুরোধ করেছি লিফটগুলো চালাতে। কিন্তু তারা শোনেননি। আমি একজন প্রবীণ। আমার হাঁটুটে ব্যথা। (দিয়াবাড়ি স্টেশনে) সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হয়েছিল। আর উত্তরার বিভিন্ন এলাকা থেকে স্টেশনে বাস দেওয়া উচিত।'
পাশে দাঁড়ানো আরেক প্রবীণ দিলিপ ডি'কস্টা তাকে নিশ্চিত করেন, 'এটা প্রথম দিন। চিন্তা করবেন না। ধীরে ধীরে তারা এসব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।'
দিয়াবাড়ির স্টেশন কন্ট্রোলার জাহাঙ্গির আলমের কণ্ঠেও একই অভয়বাণী শোনা গেল। এমআরটি পাস কেন দেওয়া হচ্ছে না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আজকে প্রথম দিন। কাল থেকে আমরা এসবের সমাধান করে ফেলব।'
সকাল ১১টার দিকেও মেট্রোর যাত্রীদের অপেক্ষার সারি আধামাইল লম্বা ছিল।
এদের অধিকাংশই হয়তো আজকে আর চড়ার শখ পূরণ করতে পারবেন না, কারণ দুপুর ১২টা বাজে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
আমি বাসের অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। রাস্তায় যানজট কেবল বাড়ছেই। হাজার হোক, দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, ঢাকা শহরের বৃহস্পতিবার।