ঢাকার আন্তঃজেলা বাস-টার্মিনাল স্থানান্তরের পরিকল্পনা আরও একধাপ এগোলো
যানজট নিরসনের লক্ষ্যে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে আন্তঃজেলা বাস-টার্মিনাল স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ঢাকার ভেতর থেকে সরিয়ে এগুলো নিয়ে যাওয়া হবে শহরের প্রবেশপথ বা প্রান্তে। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে এই পরকল্পনার সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা। এতে স্থানান্তরের পরিকল্পনা এগোলো আরও একধাপ।
বাস টার্মিনাল স্থানান্তরের এই প্রকল্পে ঢাকার চারপাশে পাঁচটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। হেমায়েতপুর, বাঘাইর, কাঁচপুর দক্ষিণ, ভুলতা এবং গ্রাম ভাটুলিয়ায় নির্মিত হবে এসব টার্মিনাল এবং সেইসঙ্গে আরও পাঁচটি নতুন বাস ডিপো নির্মিত হবে আটি বাজার, কাঁচপুর উত্তর, কাঞ্চন, বাইপাইল এবং গাজীপুরে।
প্রস্তাবিত টার্মিনালগুলো নির্মিত হলে গাবতলী, মহাখালী এবং সয়দাবাদে বিদ্যমান তিনটি বাস টার্মিনালকে সিটি বাস ডিপো হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আশা করা হচ্ছে, এতে পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসার পাশাপাশি যানজটও নিরসন হবে।
বর্তমানে ঢাকায় বিদ্যমান এই তিনটি বাস টার্মিনালে যে পরিমাণ জায়গা রয়েছে, তা রাতের বেলায় শহরের বাসগুলো পার্কিংয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে স্থানান্তর পরিকল্পনায় নতুন বাস ডিপোর রূপরেখা প্রস্তাব করা হয়েছে।
আন্তঃজেলা টার্মিনাল এবং সিটি-বাস ডিপো হিসেবে কাঁচপুর উত্তর বাস ডিপো এবং বাইপাইল ও গাজীপুর ডিপোকে বাস এবং ট্রাক ডিপো হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ২০০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
যানজট নিরসনে ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতিশীলতা বাড়াতে রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি)-এ শহরের প্রবেশপথে অতিরিক্ত আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলোর নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য নিযুক্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এন্টারপ্রাইজ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানিকে (আইআইএফসি)। গত বছরের সেপ্টেম্বরেই সমীক্ষাটি সম্পন্ন করে আইআইএফসি।
এ বিষয়ে ডিটিসিএ-এর নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীন বলেন, "স্থানান্তর পরিকল্পনাটি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। সরকারি-বেসরকারি-অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে বা গভার্মেন্ট-টু-গভার্মেন্ট ভিত্তিতে প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যবস্থার বিষয়ে আলোচনা চলছে।"
তিনি আরও বলেন, এই পরিকল্পনার কারিগরি কমিটি আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য একটি বৈঠকে এ বিষয়ে অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করবে।
কারিগরি কমিটির সদস্য সচিব সাবিহা পারভীন আরও জানান, "প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে ঢাকার সিটি কর্পোরেশনগুলো। তাদের কর্মকর্তারা ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্ধারিত জায়গা পরিদর্শন করছেন।"
বিদ্যমান বাস-টার্মিনালগুলো স্থানান্তর করা হলে, যানবাহনের সংখ্যা হ্রাস পাবে; একই সঙ্গে যান চলাচলও সহজ হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আরও বলেন, টার্মিনালগুলো রিং রোড এবং বাইপাসের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে, ফলে যাত্রীদের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে ঢাকা পার হতে হবে না। এতে কমে আসবে যানজট, দুর্ভোগ কমবে যাত্রীদের।
মাল্টিমোডাল-পরিবহন সুবিধা সম্পন্ন টার্মিনাল
সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় টার্মিনালগুলোতে মাল্টিমডাল-পরিবহন সুবিধা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে সিটি-বাস, ট্যাক্সি, অটো-রিকশা এবং প্রাইভেট কার পার্কিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকবে। এতে সহজেই যাত্রী নিয়ে টার্মিনালগুলোতে ঢুকতে ও বের হতে পারবে বিভিন্ন যানবাহন।
রাতের বেলা আন্তঃজেলা-বাসগুলো যেন নিরাপদে পার্ক করা যায়, তার জন্য যথেষ্ট জায়গা এবং বাসকর্মীদের জন্য বিশ্রাম ও রাতে থাকার জন্য ডরমেটরি সুবিধাও থাকবে এখনে।
নতুন টার্মিনালে বাস ধোয়া এবং ছোটখাটো মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপ থাকবে। উপরন্তু, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, অত্যাধুনিক টার্মিনালে বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জিংয়ের ব্যবস্থা রাখারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
মূল টার্মিনাল ভবনগুলো হবে বহুতল; নিচতলায় থাকবে বাস পার্কিয়ের সুবিধা এবং প্রাইভেট কার ও অন্যান্য যানবাহন পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে বেসমেন্টে।
এছাড়া যাত্রী ও দর্শনার্থীদের জন্য থাকবে বড়সড় ওয়েটিং-লাউঞ্জ, মায়েদের জন্য বুকের দুধ খাওয়ানোর আলাদা কর্নার, পর্যাপ্ত সংখ্যক টয়লেট, বসার ব্যবস্থা এবং পুরুষ ও নারীদের জন্য নামাযের আলাদা ঘর। এর পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখারও প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্থানীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে টার্মিনালগুলোতে নির্মিত হবে ভাস্কর্য, পেইন্টিং এবং অন্যান্য অবকাঠামো। যাত্রীদের প্রবেশ এবং প্রস্থানের জন্য থাকবে আলাদা লাউঞ্জ এবং বাসে ওঠা-নামার জন্য থাকবে আলাদা প্রবেশ ও প্রস্থান পয়েন্ট।
এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুরো টার্মিনালজুড়ে থাকবে সিসিটিভি ক্যামেরা; থাকবে ওয়াইফাই সুবিধা, প্রবেশ ও প্রস্থান পথে ডিজিটাল ডিসপ্লে এবং ই-টিকেটিং সুবিধা। শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি বই, স্টেশনারি দোকান, সেলুন, এটিএম বুথ এবং রেস্টুরেন্টও থাকবে টার্মিনালগুলোতে।
বাসকর্মীদের জন্য পৃথক ডরমেটরি ভবনের পাশাপাশি, আলাদা ক্যাফেটেরিয়া, রান্নাঘর এবং প্রার্থনার স্থান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিভিন্ন পরিবহন সমিতি এবং টার্মিনাল কর্মকর্তাদের জন্য অফিস স্পেস, কর্মীদের জন্য লকার, মনিটরিং ও সিকিউরিটি রুম, চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা, তথ্য সংকেত এবং স্টোর রুম থাকবে।
সৌর বিদ্যুৎ এবং দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনায়। এছাড়া, আবর্জনা এবং বর্জ্য-পানি ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নত সুবিধা রাখার পাশাপাশি রেইন-ওয়াটার-হার্ভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাগুলোও থাকবে নতুন টার্মিনালে।
জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার পাশাপাশি বাস-ধোয়া-বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ইটিপি সুবিধা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
টার্মিনালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসা ও জরুরি পরিষেবা, অন্তত একটি অ্যাম্বুলেন্স এবং একটি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।