বিটকয়েনে বিনিয়োগের স্বপ্ন যেভাবে দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো বগুড়ার পোথাট্টিবাসীসহ আরও অনেকের...
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2023/01/15/new_project_1.jpg)
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার পোথাট্টি গ্রাম। এই গ্রামের সহজ সাধারণ লোকগুলোর কাছে যখন রুহুল আমিন ব্যবসার প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তারা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেন নি।
নিয়মটা একদম সোজা! একটি অ্যাপের মাধ্যমে ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনে ৯০ হাজার টাকার মতো বিনিয়োগ করতে হবে। রুহুল আমিনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, বিনিময়ে ১৮ মাসের মধ্যে বিনিয়োগকারী ৩ লাখ টাকা পাবেন।
সাদাসিধে গ্রামবাসীকে এমন প্রস্তাবে প্রলুব্ধ করতে বেগ পোহাতে হয়নি রুহুল আমিন ও তার সহযোগীদের। পরিণামে দুপচাঁচিয়া উপজেলার কয়েক ডজন মানুষ হয়েছে নিঃস্ব-অসহায়।
ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতারণার শিকার হয়ে এখন এই ভুক্তভোগীরা বগুড়ার বিভিন্ন থানায় চারটি মামলা দায়ের করেছে; ফলে পোথাট্টি এখন পুলিশি তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ইতিমধ্যেই ১১ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে, যার কপি টিবিএসের হাতে এসেছে।
পিবিআইয়ের মতে, অত্যধিক লাভের আশা দেখিয়ে প্রতারকেরা শত শত গ্রামবাসীকে বোকা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। উল্লেখ্য, মহামারির সে সময়ে বেশিরভাগই তাদের চাকরি থেকে উৎখাত হয়েছিলেন।
এমনই একজন পোথাট্টি গ্রামের মোঃ আব্দুল মজিদ। পেশায় ফার্মাসিস্ট মজিদের সাথে রুহুল আমিনের পরিচয় দুই বছর আগে।
আগে যে আয় হতো, তা দিয়ে আব্দুল মজিদের ভালোই চলে যেত।
রুহুল তাকে বিটকয়েন সম্পর্কে জানায় এবং বিশ্বজুড়ে এই ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেন নিয়ে একটি ভিডিওচিত্র দেখায়। বিটকয়েন নিয়ে সেটুকু জ্ঞানের উপর ভরসা করেই তাৎক্ষণিকভাবে মজিদ রুহুলের 'রহস্যময়' ব্যবসায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
"রুহুল বলেছিল, বিটকয়েনে বিনিয়োগ অন্য যেকোনো ব্যবসার চেয়ে শতগুণ বেশি লাভজনক।"
"রুহুল আমিন এবং আরও কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সাথে কথা বলার পর আশ্বস্ত হয়ে আমি প্রায় ৯০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। 'এনজেড রোবো ট্রেড' নামক একটি অ্যাপে আমি নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খুলি। রুহুল জানায়, টাকাটা প্রথমে ইউএস ডলারে রুপান্তরিত হবে এবং এরপর একটি ডিজিটাল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করা হবে। সেই অ্যাকাউন্টেই আমি আমার প্রসিডস পাব", বলেন প্রতারণার শিকার হওয়া আব্দুল মজিদ।
তিনি বলেন, "প্রথমে আমি কিছুটা সন্দিহান এবং ভীত ছিলাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম এক মাসের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার টাকা লাভ করেছি। এতে আমি আরও বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। আস্তে আস্তে আমি প্রায় ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলাম। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে অ্যাপটি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে উঠল।"
"এরপর আমি রুহুল আমিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। দেরিতে হলেও বুঝতে পারি যে, আসলে কোনো বিটকয়েনই নেই; আমাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আমার এত কষ্টে উপার্জিত অর্থ যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে", বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মজিদ।
মজিদ আরও বলেন, "এখানে দোষ শুধু তাদের নয়, আমরাও দায়ী। আমার মতো অনেকেই এমন লোভনীয় প্রস্তাবে বিনিয়োগের সুযোগে পেয়ে সম্মোহিত হয়ে গেছিল। আমার যা ছিল, তা আমি বিভিন্ন কিস্তিতে বিনিয়োগ করে দিয়েছি। আর এখন সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব।"
মজিদের সাথে আরও ১০ জন ভুক্তভোগী বাদী হয়ে দুপচাঁচিয়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে "এনজেড রোবো ট্রেড" নামক প্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন; যেখানে রুহুল আমিনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে মজিদ উল্লেখ করেন, প্রতারকরা প্রথমে 'এনজেড রোবো ট্রেড' নামক একটি সফটওয়্যার চালু করে এবং সাধারণ মানুষকে জানায়; যেহেতু বাংলাদেশে এখনও বিটকয়েনে লেনদেন আইনগতভাবে বৈধ নয়, তাই দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড থেকে এই অনলাইন কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে প্রতারকরা পোথাট্টি গ্রামসহ বগুড়ার আরও কয়েকটি এলাকায় শাখা খোলে।
এজাহারে মজিদ আরও জানান, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি এবং পোথাট্টি গ্রামের আরও দশ ব্যক্তি এই প্রতারকদের ব্যবসায় প্রায় ৫৩০০ ডলার (৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৪৮ টাকা) বিনিয়োগ করেছেন।
অন্য বিনিয়োগকারীরা হলেন ফাতেমা (২৮,২০০ টাকা), ফাহমিদা (১,০৯০ টাকা), মর্জিনা (৪৬ হাজার ২০০ টাকা), বীথি খাতুন (২৮ হাজার ২০০ টাকা), রাজিয়া (৯০ হাজার টাকা), পলি (৯০ হাজার টাকা), হারুনুর রশীদ (৯০ হাজার টাকা), নাসিমা (৪৬ হাজার ২০০ টাকা), আলতাফ (২৮ হাজার ২০০ টাকা) এবং বাশার (২৮ হাজার ২০০ টাকা)।
মামলায় মজিদ দুপচাঁচিয়া উপজেলার আট ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করেছেন। এরা হলেন- রুহুল আমিন (৩৫), মো. ইসমাইল হোসেন (২৮), গোলাম মোস্তফা সরকার (৫৫), মো. আবু সাঈদ (৫৩), মো. মাসুদ রানা (২৭), মো. মাইনুল ইসলাম (২৭), মো. বেলাল হোসেন (৫৬) এবং মো. কামরুল ইসলাম (৩৩)।
এখন পর্যন্ত বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫৬ জন ভুক্তভোগী এই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তাদের ভাষ্যে, তথাকথিত বিটকয়েনের ব্যবসায় তারা প্রায় ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
পিবিআই সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট আবু ইউসুফ টিবিএসকে বলেন, "তদন্ত শেষ করার পর আমরা সর্বমোট ৩৯ হাজার ৭০০ ডলার জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছি, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় তা প্রায় ৩২ লাখ টাকা।"
যেহেতু এখনও পর্যন্ত ভুক্তভোগীদের সবাই মামলা করতে এগিয়ে আসেনি, তাই সত্যিকার ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে আরও বেশি হতে পারে, যোগ করেন তিনি।
পিবিআই বলছে, ২০২১ সালের আগস্টে পোথাট্টি গ্রামের ফরিদ উদ্দিন প্রামাণিক নামের এক ব্যক্তি মামলা করার পর র্যাব এনজেড রোবো ট্রেডের কার্যালয়ে অভিযান চালায় এবং মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় থাকা রুহুল আমিন, ইসমাইল হোসেন, বেলাল হোসেন ও কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে।
এসময় র্যাব তাদের কাছ থেকে নগদ ৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা এবং একাধিক ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করে। তবে কয়েক মাস আটক থাকার পর তারা জামিনে মুক্তি পান এবং জেল থেকে বেরিয়ে আসে্ন।
তদন্তের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা বলেন, মামলার প্রধান আসামী রুহুল আমিন একসময় সিঙ্গাপুরে বসবাস করতো। দেশে ফেরার পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সে পোথাট্টি গ্রামে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে 'এনজেড রোবো ট্রেড' কোম্পানি চালু করে এবং স্থানীয়দেরকে এখানে বিনিয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকে।
মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা ও বগুড়া পিবিআই-এর পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট আকরামুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ভুক্তভোগীরা ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েন সম্পর্কে কোনো ধারণা না নিয়েই তাদের কষ্টার্জিত টাকা এনজেড রোবো ট্রেডে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে তাদের এই টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।"
বিটকয়েন কী
ইনভেস্টোপিডিয়া অনুযায়ী, বিটকয়েন হলো এক ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি। ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামের কেউ কিংবা একদল সফটওয়্যার ডেভেলপার নতুন ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রার প্রচলন করে। এ ধরনের মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে পরিচিতি পায়। নাকামোতোর উদ্ভাবিত সে ক্রিপ্টোকারেন্সির নাম দেওয়া হয় বিটকয়েন।
বিটকয়েন লেনদেনের জন্য কোন ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বা নিকাশ ঘরের প্রয়োজন হয় না। পিয়ার-টু-পিয়ার, অর্থাৎ গ্রাহকের সাথে গ্রাহকের সরাসরি যোগাযোগে অনলাইনে লেনদেন হয় বিটকয়েন।
বিটকয়েনের মাধ্যমে হওয়া প্রতিটি লেনদেন ব্লকচেইনে লেখা থাকে এবং বিটকয়েন ব্লকচেইনের সমস্ত তথ্য নেটওয়ার্ক জুড়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকে।