সময়, অর্থ নষ্ট করে এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ বিআরটি র্যাম্প
সাড়ে ২০ কিলোমিটার সড়ক করিডোর উন্নয়নের মাধ্যমে দ্রুতগামী বাসের জন্য ডেডিকেটেড লেন চালু করতে ২০১২ সালে নেওয়া বিআরটি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে পাঁচবার। ডিসেম্বরে সর্বশেষ সময়সীমা বিবেচনায় দ্রুত কাজ এগিয়ে নেয়ার কথা থাকলেও উল্টো পথে হাটছে কর্তৃপক্ষ। দুর্বল উপকরণ ব্যবহারের কারণে বেশ কয়েকদিন ধরেই বিমানবন্দর এলাকায় প্রকল্পের একটি র্যাম্প ভাঙ্গা হচ্ছে।
গতকাল প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে বিআরটির একটি র্যাম্প থেকে স্ল্যাব খুলছেন কর্মীরা। সড়কের পাশে এবং সড়ক বিভাজকে এ সব স্ল্যাব রাখা হচ্ছে।
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কটিতে বিআরটি সেবা চালু করতে চার বছর সময় বেধে দিয়েছিল সরকার। ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন, কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা, ঠিকাদারের অনীহার কারণে প্রকল্পের মেয়াদকাল দফায় দফায় বেড়েছে। একই সঙ্গে ২২২৮.৪৮ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২৬৮.৩২ কোটি টাকায়।
গত বছরের শেষ দিকে প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফায় বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হলে বেশ কিছু শর্তে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে এর আগেই আগামী জুনে সড়কটি যানবাহনের জন্য চালু করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এ লক্ষ্যও পূরণ হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিআরটি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিমানবন্দর এলাকায় ৫০০ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্যের র্যাম্পটির প্রায় অর্ধেক নির্মাণের পর মেকানিক্যালি স্ট্যাবিলাইজড আর্থ ওয়াল-এ নিম্নমানের স্ট্রিপ ব্যবহারের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে ত্রুটি দূর করতে চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কর্পোরেশন (সিজিজিসি) কে নির্দেশনা দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এরই প্রেক্ষিতে সাব কন্ট্রাকটরের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে অন্য উৎস থেকে স্ট্রিপ সংগ্রহ করার পর নতুনভাবে কাজ শুরু করে সিজিজিসি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, এই র্যাম্পটির বিভিন্ন জায়গায় প্রস্থের মাপে কিছুটা ভুল রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। র্যাম্পের সব স্ল্যাব আলাদা করে আবার প্রস্থের মাপ নেয়া হবে। কোথাও প্রস্থ কম থাকলে পুরো র্যাম্প ভাঙ্গা হবে। আর সব কিছু ঠিক থাকলে নতুন স্ট্রিপের মাধ্যমে স্ল্যাবগুলো জুড়ে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে।
কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা আর অদক্ষতার কারণেই প্রকল্পের কাজে বারবার বিঘ্ন ঘটছে বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক। টিবিএসকে তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ সুপারভিশনের জন্যে বিশাল অঙ্কের ব্যয় ধরে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ঠিকমত কাজ করলে নিম্নমানের কোন উপকরণই ব্যবহারের সুযোগ থাকে না।
তিনি বলেন, বিমানবন্দর থেকে ৪০ মিনিটে গাজীপুর পৌঁছানো, ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনসহ বড় স্বপ্ন দেখিয়ে প্রকল্পটি নেয়া হলেও বাস্তবায়নে কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কাজটি দ্রুত শেষ করে সেবা চালুর বিপরীতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বরাবরই লক্ষ্য ছিল মেয়াদ বাড়িয়ে ব্যয় বৃদ্ধি। নিজেদের ব্যয় কমাতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এর ফলে প্রাণহানিকর একাধিক দুর্ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন এই অধ্যাপক।
অবশ্য বিআরটি প্রকল্পের মূল র্যাম্প ভাঙ্গা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করে ঢাকা বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, "নিয়মিত পরীক্ষায় বিআরটির র্যাম্পের মেকানিক্যালি স্ট্যাবিলাইজড আর্থ ওয়াল-এ ত্রুটি ধরা পড়ে। এই ওয়ালের স্ল্যাবগুলো জোড়া রাখতে ব্যবহার করা স্ট্রিপে স্ট্রেংথ কিছুটা কম পাওয়া যায়। এই ত্রুটি ধরা পড়ার পরই এ অংশের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়।"
তিনি আরও বলেন, "নতুন সাব কন্ট্রাকটর নিয়োগ করে নতুন সোর্স থেকে স্ট্রিপ এনে কাজটা শুরু করা হয়েছে। আসলে এখানে কোন কিছুই ভাঙ্গা হচ্ছে না। ওয়ালের বিভিন্ন অংশ খুলে নতুন স্ট্রিপ লাগিয়ে আবার যথাস্থানে স্থাপন করা হবে।"
দায়দায়িত্বের বিষয়ে তিনি বলেন, কাজের মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঠিকাদারের। তবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এই ধরনের উপকরণ বানায় না।
আর্থিক ক্ষতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরো একটি প্যাকেজের আওতায় ১৬ কিলোমিটার বিআরটি নির্মাণের কাজ করছে চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। নির্দিষ্ট কোন অংশ বা একটি র্যাম্প নির্মাণের ব্যয় আলাদাভাবে প্রকল্পে ধরা নেই। এ হিসাবে আর্থিক দায় ঠিকাদারকেই নিতে হবে।
তিনি বলেন, "ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যদি সাব-কন্ট্রাকটর থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে তবে তাদের ক্ষতি তুলনামূলক কম হবে। আর যদি তা করতে না পারে তবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে। এতে সরকারের লাভ লোকসানের কোন হিসাব নেই।"
তবে এই ভাঙ্গা-গড়ার কাজে এই অংশের কাজে কিছুটা বাড়তি সময় লাগবে বলে মনে করেন সরকারের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, স্ট্রিপগুলোতে ত্রুটি ধরা পড়ার পর কাজ কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়েছে। আর এখন এগুলো খুলে আবার লাগাতেও কিছুটা বাড়তি সময় লাগছে। তবে এই কারণে পুরো প্রকল্পের বাস্তবায়নে বাড়তি সময় লাগবে না বলে তিনি মনে করেন।
৮৫৫.৩৭৫ কোটি টাকায় ১৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি ছয় ফ্লাইওভার, ১৯ বিআরটি স্টেশন নির্মাণ ও ড্রেন নির্মাণের কাজ করছে চায়না গেজুবা গ্রুপ কর্পোরেশন (সিজিজিসি)। সড়ক বিভাগের প্রাক্বলনে এ খাতে ৯১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও ৬.৫২% কম ব্যয়ে কাজটি নিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
৯১৭ দিনের মধ্যে কাজ হস্তান্তরের কথা থাকলেও পরে তা ১১৬৪ দিনে বাড়ানো হয়। এ সময়সীমা পেরিয়ে গেলে আরও ৪৮০ দিন সময় চায় প্রতিষ্ঠানটি।
৯৩৫.১২৯৭ কোটি টাকায় সাড়ে চার কিলোমিটার উড়াল সড়ক নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ পেয়েছে চীনের জিয়াংসু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি (জেটিইজি)। ১২৮৮ কোটি টাকার এই কাজ ২৭.৩৯% কম দামে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখছে ঠিকাদার। চুক্তির সময়সীমা ৯১৭ দিন পার হয়ে গেলেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি না থাকায় এ ঠিকাদারও বাড়তি সময় চেয়েছে।