বিরল রক্তের গ্রুপ বোম্বে: জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন ডেটাবেইজ
সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের রোগী লক্ষীপুরের রায়পুরের গৃহিণী মিনু (৪২)। অপারেশনের জন্য তার প্রয়োজন রক্ত।
রক্ত দেওয়ার আগে পরীক্ষায় জানা যায়, তার রক্তের গ্রুপ 'ও' পজিটিভ। গত বৃহস্পতিবার অপারেশনের সময় তাকে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। পরে আরেক ব্যাগ রক্ত দেওয়ার সময় জানা যায় ডোনারের সাথে রক্তের গ্রুপ মিলছে না।
২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ) এর ট্রান্সফিউশন ডিপার্টমেন্টে মিনুর রক্তের স্ক্রিনিং করে শনাক্ত হয় যে তার রক্তের গ্রুপ 'বোম্বে'।
বোম্বে ব্লাড গ্রুপ বিশ্বের সবচেয়ে বিরল রক্তের গ্রুপগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে একজনের দেহে পাওয়া যায় এ গ্রুপের রক্ত।
১৯৫২ সালে ভারতের বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) এটি প্রথম শনাক্ত করা হয় বলে, বিরল এই রক্তের গ্রুপটি 'বোম্বে ব্লাড গ্রুপ' হিসেবে পরিচিত।
মিনুর দেহে এই বিরল রক্তের সন্ধান মিললেও অবশ্য তার পরিণতি হয় করুণ।
অপারেশনের সময় 'বোম্বে' গ্রুপের রক্তের পরিবর্তে ও পজিটিভ রক্ত দেওয়ায় মিনুর কিডনি বিকল হয়ে যায়। ২১ জানুয়ারি তাকে বিএসএমএমইউ এর আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।
মিনুর কিডনি ডায়ালাইসিস করার জন্য বোম্বে গ্রুপের রক্ত প্রয়োজন। তার পরিবারের সদস্যরা ফেসুবকে বিভিন্ন পেজে বোম্বে গ্রুপের রক্ত চেয়ে আবেদন জানায়।
ফেসবুকে বোম্বে গ্রুপের রক্ত চেয়ে সাহায্যের পোস্টটি ছড়িয়ে পরার পর বোম্বে গ্রুপের দুজন রক্তদাতা দুই ব্যাগ রক্ত দান করেছিলো মিনুকে। তবে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি তাকে, সোমবার বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
যদিও বোম্বে ব্লাড গ্রুপ বিশ্বের অন্যতম বিরল একটি রক্তের গ্রুপ, এবং বাংলাদেশও যেহেতু এই উপমহাদেশেরই একটি অংশ, এই রক্তের অধিকারী ব্যক্তির সংখ্যা এ দেশেও কম হওয়ার কথা নয়।
ভারতে প্রতি ১৭,৬০০ জনে একজন বা বিশ্বের প্রতি ২৫,০০০ জনে একজনের দেহে এই রক্তের গ্রুপ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বোম্বে গ্রুপের বাহক ঠিক কতজন, তা নিয়ে জাতীয় কোনো ডেটাবেইজ নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে 'বোম্বে' গ্রুপের রক্ত শনাক্ত করা হয়। এখন পর্যন্ত মিনুর পর ৩০ জনের বেশি মানুষের দেহে বোম্বে গ্রুপের রক্ত শনাক্ত করেছে বিএসএমএমইউ।
বিরল এবং ব্যয়বহুল
রক্ত সঞ্চালন, শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির সহকারী অধ্যাপক (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) ডক্টর আশরাফুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বোম্বে গ্রুপ নির্ণয়ের কেমিক্যালের দাম বেশি। ৬ মাস পর পর কেমিক্যালের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এই গ্রুপের মানুষ সচরচর পাওয়া যায় না তাই এ কেমিক্যাল সব হাসপাতালে থাকেনা।"
"বিএসএমএমইউ যেহেতু ইউনিভার্সিটি তাই সেখানে এ কেমিক্যাল রেগুলার কেনা হয়। আমরা যখন কোন ব্লাড গ্রুপকে বোম্বে বলে সন্দেহ করি তখন তার রক্ত বিএসএমএমইউতে পাঠাই।"
ড. আশরাফুল হক আরো বলেন, বোম্বে ব্লাড গ্রুপের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এর বাহকরা একই গ্রুপ ছাড়া কাউকে রক্ত দিতে পারবেনা; অন্য গ্রুপের রক্ত নিতেও পারবেনা।
"তাই এই রেয়ার গ্রুপের রক্তের ডেটাবেইজ তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে সন্তান জন্মদান, দুর্ঘটনাসহ কোন ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতে এই গ্রুপের মানুষের সাথে যোগাযোগ করলে তারা রক্ত দিতে পারেন।"
এছাড়া 'ও 'নেগেটিভ ও বোম্বের মত বিরল গ্রুপের রক্ত প্রক্রিয়াজাত করে সাত বছরের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। সে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যদি কারো দেহে এ গ্রুপের রক্ত থাকে, তাহলে তার রক্তে এ অ্যান্টিজেন এবং বি অ্যান্টিবডি থাকে।
এবি গ্রুপের লোকেদের রক্তে এ, বি দুটি অ্যান্টিজেনই থাকে এবং কোনো অ্যান্টিবডি থাকে না।
ও-টাইপের লোকেদের রক্তে এ, বি অ্যান্টিবডি থাকেম কিন্তু কোনো অ্যান্টিজেন থাকেনা।
তবে এ অ্যান্টিজেনগুলো ছাড়াও সব রক্তের গ্রুপে 'এইচ' অ্যান্টিজেনও রয়েছে।
৯৯.৯% লোহিত রক্তকণিকায় এইচ অ্যান্টিজেন থাকে।
অপরদিকে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ অর্থাৎ 'এইচএইচ' (hh)-এর বেলায় লোহিত রক্তকণিকার ঝিল্লিতে এইচ অ্যান্টিজেন থাকেনা, এবং সিরামে থাকে অ্যান্টি-এইচ। এ গ্রুপের লোহিত রক্তকণিকায় বা অন্যান্য টিস্যুতে কোনো এ, বি কিংবা এইচ অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি পাওয়া যায়না।
'বোম্বে' গ্রুপের রক্ত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বিএসএমএমইউ'র অধ্যাপক (ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ) ডা. আয়েশা খাতুন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশে ও পজিটিভ ব্লাড গ্রুপ ৩৩% এর বেশি। সাধারণত রাস্তায় বা বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে ব্লাড গ্রুপিংয়ের সময় গ্রুপ নির্ণয় না করা গেলে সেটাকে ও গ্রুপ বলে দেওয়া হয়।"
"কিন্তু যাদের ব্লাড গ্রুপ ও তারা সত্যি ও গ্রুপের কিনা তা নিজ উদ্যোগে কনফার্ম হওয়া উচিৎ। ব্লাডের গ্রুপিং সঠিকভাবে করা হলে শুরুতেই ধরা পড়বে,"
"বোম্বে বা ওএইচ ব্লাড গ্রুপিংয়ের সময় ও পজিটিভ ব্লাড গ্রুপ পাওয়া গেলে ট্রান্সফিউশনের কাজে জরিতদের এবং ও পজিটিভ রক্তের ব্যক্তি সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে," বলেন তিনি।
দেশে বোম্বে গ্রুপের যারা রক্ত দানে সক্ষম ব্যক্তি আছে তাদের নিয়ে ডোনার গ্রুপ চালু করার প্রস্তাবনা দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের কনসালটেন্ট (নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন কর্মসূচি) অধ্যাপক ডা. সৈয়দা মাসুমা রহমান টিবিএসকে বলেছেন, "ন্যাশনালি বোম্বে গ্রুপের রক্ত কত মানুষের শরীরে আছে তার এখন পর্যন্ত কোন ডেটাবেইজ নাই। এ গ্রুপের রক্তের চাহিদা অনেক কম, চাহিদা যদি বাড়ে তাহলে ডেটাবেইজ তৈরি করা হবে।"
বাংলাদেশির প্রাণ বাঁচাতে মুম্বাই থেকে এসেছিলো রক্ত
২০১৬ সালের ২১ মে ২৫ বছর বয়সী কামরুজ্জামান ট্রাফিক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। একাধিক ফ্র্যাকচার এবং পেলভিস ডিসপ্লেসমেন্ট নিয়ে তাকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অবিলম্বে অর্থোপেডিক অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল তার।
রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, তার দেহের রক্ত সচরাচর গ্রুপের রক্তের সাথে মিলছে না।
পরে বিএসএমএমইউ শনাক্ত করে, কামরুজ্জামানের দেহে বিরল বোম্বে ব্লাড গ্রুপ ছিল।
কামরুজ্জামান যে প্লাস্টিক কারখানার কর্মচারী ছিলেন, সেখানকার উচ্চপদস্থরা সারা শহরে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন, প্রতিটি হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ করেন।
কেউ এই রক্তের গ্রুপের নামই শুনেনি। এমনকি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্লাড ব্যাংকগুলোরও ছিল একই অবস্থা।
এরপর অনলাইন এবং অফলাইনে অনুসন্ধান করতে করতে তাদের যোগাযোগ হয় মুম্বাই-ভিত্তিক এনজিও থিংক ফাউন্ডেশনের সাথে।
তারা সেসময় জানতে পারেন, ভারতে এই গ্রুপের রক্তদাতাদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তবে দেশটিতে ৪০০ জনেরও কম লোকের দেহে বোম্বে ব্লাড গ্রুপ আছে বলে জানা যায়, দাতা হিসেবে পাওয়া যায় মাত্র কয়েকজনকে।
অবশেষে কামরুজ্জামানকে বাঁচাতে রক্ত দেন মুম্বাইয়ে বসবাসরত ৪ ভারতীয়।
২০ জুন দেশে রক্ত আসে, কামরুজ্জামানের অপারেশন হয়। অবশেষ সুস্থ হন তিনি।
তবে কামরুজ্জামান ছিলেন সৌভাগ্যবানদের একজন।
এ ধরনের রক্তদানের ঘটনা যাতে দেশে নিজ উদ্যোগেই ঘটে, সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।