এলসি খুলতে না পারায় বাজারে ব্লাড ব্যাগের সংকট
ডলার সংকটের কারণে এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট/ঋণপত্র) খুলতে সমস্যা হওয়ায়, বিশ্ববাজারে দাম এবং কাস্টমস খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী ব্লাড ব্যাগ আমদানি করতে পারছেন না আমদানিকারকরা। ফলে দেশের হাসপাতালগুলোতে দেখা দিয়েছে ব্লাড ব্যাগের সংকট।
রক্তদাতা থাকলেও ব্লাড ব্যাগের অভাবে তাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে পারছে না ব্লাড ব্যাংকগুলো। প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্লাড ব্যাগের অভাবে দেশে রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে ভর্তি বার্নের (দগ্ধ) রোগীদের চিকিৎসায় ডাবল ব্লাড ব্যাগ প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু হাসপাতালটিতে এখন ডাবল ব্লাড ব্যাগের যে মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ১০ দিন কাজ চালানো যাবে। বার্ন ইনস্টিটিউটে মাসে ১,৬০০ থেকে ২,০০০টি ব্লাড ব্যাগের প্রয়োজন হয়।
ডাক্তাররা জানান, সার্জারির জন্য সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগের প্রয়োজন হলেও অ্যানিমিয়া-থ্যালাসেমিয়া রোগীদের ব্লাড দিতে, প্লাটিলেট দেওয়া, প্লাজমাসহ বিভিন্ন কাজে ডাবল ও ট্রিপল ব্লাড ব্যাগের প্রয়োজন হয়। ব্যাগগুলো নির্ভরযোগ্য স্যাম্পল সংগ্রহ, তা পৃথকীকরণ, সঞ্চয় এবং পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ আশরাফুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দেশে সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগের চাহিদা কম, তাই সিঙ্গেল ব্যাগের মজুদ কিছুটা আছে। কিন্তু ডাবল ও ত্রিপল ব্যাগের সংকট দেখা দিয়েছে।"
"সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপোট থেকে আমাদের ব্লাড ব্যাগ সরবরাহ করা হয়। সেখানে সরবরাহ শেষ হলে আমরা লোকাল মার্কেট থেকে কিনি। বেশ কয়েকদিন ধরেই লোকাল মার্কেটে যোগাযোগ করছি আমরা, কিন্তু কেউ ব্যাগ দিতে পারছে না," যোগ করেন ডাঃ আশরাফুল হক।
ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে বছরে আনুমানিক ২০ লাখ ব্লাড ব্যাগের প্রয়োজন হয়, যার পুরোটাই আমদানি নির্ভর। সিঙ্গাপুর, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন থেকে ব্লাড ব্যাগ আনেন আমদানিকারকরা।
জেএমআই গ্রুপ দেশে ব্লাড ব্যাগের চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করে। তবে কোম্পানিটির অনলাইন শপিং সাইটে গিয়ে দেখা যায়, সিঙ্গেল, ডাবল, ট্রিপল- কোনো ধরনের ব্যাগের সরবরাহই এই মুহূর্তে নেই সেখানে, এমনকি দামও উল্লেখ নেই।
জেএমআই গ্রুপের জেএমআই সিরিঞ্জস অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক অভিজিৎ পল টিবিএসকে বলেন, "এলসি খুলতে না পারায় যথেষ্ট ব্যাগ আমদানি করা যাচ্ছে না। এছাড়া, বিশ্ববাজারে দামও অনেক বেশি; ডলার সংকটের কারণে দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।"
"তারপরও এলসি'র ব্যবস্থা করা হয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যে ছোট একটি চালান আসবে," যোগ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেলসহ অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে ব্লাড ব্যাগ সরবরাহকারী ও মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে টিবিএসকে বলেন, "ডাবল, ট্রিপল ব্যাগের সংকট বেশি। গত বছরের জুলাই-আগস্টের পর আমরা আর প্রোডাক্ট আনতে পারিনি। ডলার সংকটটাই এখানে মূল কারণ। ডলার সংকটের জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না।"
তিনি আরো বলেন, "ইউরোপের দেশগুলো থেকে ইউরোতে পণ্য কিনতে হয়। ইউরোর দামও অনেক বেশি। এছাড়া, কাস্টমস ডিউটি মার্জিন ১৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে পণ্য আমদানিতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে; আবার এদিকে, পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেলে তা বিক্রি করা যাবেনা। তাই আমরা পণ্য আনতে পারছি না।"
প্রতিবছর বইমেলায় বাংলাদেশ পুলিশের স্টলে স্বেচ্ছাসেবীরা রক্ত দান করেন; সেখান থেকে রক্ত সংগ্রহ করে সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে রাখা হয়। ব্লাড ব্যাগ সংকটের কারণে এ বছর স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা থাকলেও অন্যান্য বছরের তুলনায় কম রক্ত সংগ্রহ করছে পুলিশ হাসপাতাল।
পুলিশ ব্লাড ব্যাংকের ইনচার্জ, উপ-পরিদর্শক একেএম সিদ্দিকুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, "ব্যাগ সংকটের কারণে এ বছর বইমেলা থেকে খুব কম রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। দাতা আছে, কিন্তু আমরা রক্ত নিতে পারছিনা। গত বছর আমরা ১,৫০০ ব্যাগের মত রক্ত সংগ্রহ করেছিলাম, যা পরবর্তীতে প্রসেসিং করে সাধারণ মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়েছে। এবার হয়তো ৬০০ ব্যাগ সংগ্রহ করা যাবে।"
তিনি আরও বলেন, "ডাবল ব্যাগ সংকটের কারণে আমরা প্ল্যাজমা তৈরি করতে পারছি না, ফলে বার্ন ইউনিটের রোগীরা ভুগছেন। আমাদের হাসপাতালে মাসে ১,২০০ থেকে ১,৫০০ সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগ, ২০০ থেকে ৩০০ ডাবল ব্যাগ এবং ২০ থেকে ৩০টি ট্রিপল ব্যাগের প্রয়োজন হয়। এখন সব ধরনের ব্যাগের সংকট দেখা দিয়েছে।"
"আগে কিছু ব্যাগ কিনেছিলাম; সেইফ ব্লাড ট্রান্সফিউশন ডিপার্টমেন্ট থেকে কিছু ব্যাগ দিয়েছিল, যা দিয়ে কার্যক্রম চলছে। তবে যা আছে তা দিয়ে হয়তো এক থেকে দেড় মাস আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবো।"
"আমরা বিএমএ মার্কেট থেকে ব্যাগ কিনি, কিন্তু সেখানে এখন ব্যাগ পাচ্ছি না। জেএমআই-এর কাছেও ব্যাগ নেই। নন-ব্রান্ড যে কোম্পানি থেকে ব্যাগ কিনি, সেগুলোর দাম অনেক বেশি; তাও পাওয়া যাচ্ছে না," যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডাঃ শেখ দাউদ আদনান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের হাতে কিছু ব্লাড ব্যাগ আছে, হাসপাতালগুলোর চাহিদা অনুযায়ী তা বণ্টন করা হবে।"