ব্যবসা-বান্ধব করতে শতাব্দী প্রাচীন কোম্পানি আইনে আমূল পরিবর্তন আনতে বলেছে হাইকোর্ট
কোম্পানি আইন-১৯৯৪ 'আমূল পরিবর্তন' করে একটি নতুন আইন তৈরির জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে বলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছে, প্রচলিত আইনটি যুগোপোযোগী না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই তা কার্যকর নয়, ফলে বাংলাদেশের উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান আইনটি বড় বাধা।
একইসাথে, প্রাইভেট ও পাবলিক কোম্পানির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধসহ সকল ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তিতে ১৪ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২৩২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলে, "বর্তমান কোম্পানি আইন ১৯৯৪ অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগের অনুপযোগী। একে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ বলা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটি পুরোটাই কোম্পানি আইন ১৯১৩-ই রয়ে গেছে। উপরিল্লিখিত অবস্থাধীনে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিতে হলে অতি অবশ্যই ১০৯ বছর পুরোনো কোম্পানি আইন আমূল পরিবর্তন একান্তভাবে অপরিহার্য।"
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোম্পানি গঠন, পরিচালনা এবং কোনো ধরনের বিরোধ তৈরি হলে সেটি প্রতিকারের পথ বাতলিয়ে দেয় কোম্পানি আইন।
কিন্তু আইনটা যুগোপোযোগী না হওয়ায়, এই আইনের অনেক কিছুই বাস্তবায়ন সহজ নয়। এছাড়াও আইনে অনেক বিষয় অস্পষ্ট থাকায় সেটির কারণে আদালতে প্রচুর পরিমাণ মামলা হচ্ছে। যেগুলো নিষ্পত্তিতে লাগে দীর্ঘ সময়।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আদালতে মামলা দ্রুত নিষ্পতি না হওয়ায় কোম্পানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছে। ফলে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান এমনকি বিদেশি কোম্পানিও সহজে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না বাংলাদেশে।"
এছাড়াও বর্তমান কোম্পানি আইনে অনেক বিষয় নিয়ে কোনো বিধান নেই। ফলে সেটি নিয়েও আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়, যোগ করেন তানজীব-উল-আলম।
বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স ২০২০ অনুসারে, চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রে ১৯০টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ ১৮৯ তম স্থানে রয়েছে। এটি এমন একটি সূচক, যার মাধ্যমে বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ব্যয়িত সময় এবং ব্যয় এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার গুণমান পরিমাপ করে।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট প্রবীর নেওগী বলেন, "পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানি আইনের সাথে আমাদের আইনের অনেক ব্যবধান রয়েছে। ফলে ওসব দেশের আইন-আদালত ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় তার আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।"
তিনি আরো বলেন, "আমাদের কোম্পানি আইনে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালতের পরিমাণ উল্লেখ নেই, অথচ লাখ লাখ মামলা আসে। যে মামলাগুলো প্রচলিত আদালতে বিচার হচ্ছে।"
তিনি উল্লেখ করেন, কোম্পানি নিবন্ধনের পর সেটি রেগুলেটিং করার জন্য যথাযথ বিধান নেই। বিদেশে কোম্পানি ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি (এডিআর) বাধ্যতামূলক হলেও তা বাংলাদেশে নেই।
অ্যাডভোকেট প্রবীর বলেন, একটি কোম্পানির পরিচালকদের মধ্যে মতের অমিল হলে, সেটির সমাধান কিভাবে সম্ভব সেটির বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এরকম বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আদালতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়। এছাড়াও, কোম্পানির এজিএম কোথায় হবে, এটি নিয়ে আইনে স্পষ্ট বিধান নেই।
এই আইনজ্ঞ বলেন, কোম্পানি আইনে এরকম অর্ধশতাধিক সমস্যা আছে। যেগুলোর কারণে দেশে অনেক কোম্পানি থাকলেও তাদের জন্য ব্যবসা করা কঠিন।
লক্ষাধিক মামলার শুনানি হয় একটিমাত্র বেঞ্চে
হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে, দেশে প্রচুর সংখ্যক বেসরকারি ও সরকারি সংস্থা রয়েছে। কিন্তু কোম্পানি সম্পর্কিত মামলা পরিচালনার জন্য হাইকোর্ট বেঞ্চ রয়েছে কেবল একটি।
কোম্পানি আদালতের অভাবের কারণে অসংখ্য কোম্পানির মামলা নিষ্পত্তি স্থবির হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে আদালত বলছে, কোম্পানির বিরোধ মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত আদালতের অভাবের কারণে কোম্পানিগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
আরজেএসসি সুত্রে জানা যায়, জানুয়ারি মাসের হিসাব অনুযায়ী দেশে ২,৭৯,১৬৭টি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, ফরেইন কোম্পানি, পার্টনারশিপ ফার্ম এবং ওয়ান পারসন কোম্পানি রয়েছে।
সূত্র থেকে জানা গেছে, হাইকোর্ট ও বিচারিক আদালতে বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার মামলা এখনো পর্যন্ত অনিষ্পন্ন রয়েছে। যে মামলাগুলোর সাথে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার লেন-দেন সংক্রান্ত বিরোধ জড়িত।
এসব মামলার মধ্যে বিদশি বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সাথে বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির মামলা প্রায় ৩৪ হাজার।
দুই লাখ ১১ হাজার মামলার মধ্যে দশ বছরেরও বেশি পুরনো মামলা রয়েছে প্রায় ৩৯ হাজার।
প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত বিরোধ, মালিকানা নিয়ে বিরোধ, চুক্তি লংঘন সংক্রান্ত বিরোধ, প্রতারণা, বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিরোধ, মানহীন পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে এসব মামলার অভিযোগে।
২০১৬ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলোর এক স্টাডিতে উঠে এসেছে, বাণিজ্য বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির অভাবে প্রতিবছর বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়। আর শুধু বাংলাদেশেই এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
হাইকোর্টের ১৪ সুপারিশ
বুধবার প্রকাশিত রায়ে হাইকোর্ট দ্রুততার সঙ্গে ভারতের কোম্পানি আইনের আদলে বাংলাদেশের কোম্পানি আইন সংশোধন করে নতুনভাবে প্রণয়ন এবং প্রতি বছর আইন আপডেট করার উদ্যোগ নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
এছাড়াও প্রতিটি জেলায় কোম্পানির সংখ্যানুপাতে এক বা একাধিক কোম্পানি আইনের ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং প্রতিটি বিভাগে একটি করে কোম্পানি আপিল্যাট ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরামর্শ দিয়েছে।
কোম্পানি আইনের অধীনে অপরাধ সমূহের জন্য বিশেষ ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে হাইকোর্ট।
যৌথমূলধনী কোম্পানি ও কার্যসমূহের পরিদপ্তরকে (আরজেএসসি) আধুনিককরণ ও আইনি কাঠামো শাক্তিশালীকরণের নিমিত্তে এবং এর সেবার উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ প্রদান করেছে হাইকোর্ট।
প্রত্যেক কোম্পানিতে একজন স্থায়ী আইন কর্মকর্তার নিয়োগ বাধ্যতামূলক; প্রতিটি জেলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কোম্পানি গঠন, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন; প্রতি কোম্পানিতে একজন করে নিরপেক্ষ পরিচালক, কোম্পানির সচিব, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা; পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকার উপরে হলে প্রত্যেক কোম্পানিতে সার্বক্ষণিক কোম্পানি সচিব রাখার পরামর্শ দিয়েছে হাইকোর্ট।
কোম্পানির কার্যালয় যে শহরে নিবন্ধিত, সে শহরে এজিএম বাধ্যতামূলক করে দ্রুত পরিপত্র ইস্যু করা; শেয়ারবাজারের আইনের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) অনাহূত পরিস্থিতির অবসান, রিটার্ন দাখিল সহজতর করা; এজিএমে বা অন্য কোথাও কোম্পানির পক্ষ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের কোনোরূপ উপহার, উপঢৌকন, নগদ অর্থ প্রদান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করে বিধি প্রণয়ন, এজিএম অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নিবন্ধন আপনা আপনি বাতিল মর্মে বিধি প্রণয়ন এবং লাভ-ক্ষতির হিসাব, উদ্বৃত্তপত্র, রিটার্ন বা করের বিষয় আরজেএসসিতে দাখিল করার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বিধি বিধান করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
যেভাবে মামলা
মামলার নথিসূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সালে একক মালিকানায় মো. সৈয়দ হোসেন কাপড় এবং সেলাই এর ব্যবসা শুরু করে এ্যালিফেন্ট রোডে টপটেন নামে প্রথম শোরুম প্রতিষ্ঠা করেন।
আপন ছোট ভাই মো উজ্জ্বল ও আব্দুল আউয়ালকে পিতার আদরে বড় করে তাদেরকেও নিজের পায়ে সু-প্রতিষ্ঠিত করার মানসে ২০১১ সালে টপটেন মার্ট লিমিটেড কোম্পানি করে ছোট ভাই উজ্জ্বলকে ৩৫% শেয়ার ও আব্দুল আউয়ালকে ৫% শেয়ার প্রদান করেন এবং নিজে ৬০% শেয়ার গ্রহণ করেন।
একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ শুরু হলে ২০১৯ সালে ছোটভাই মো উজ্জ্বল কম্পানিতে বড় ভাইয়ের থাকা সকল শেয়ার নেওয়ার দাবীতে হাইকোর্টে মামলা করে।
গত আগস্টে সেই মামলা নিষ্পত্তি করে মো উজ্জ্বলের সকল শেয়ার মো. সৈয়দ হোসেনের কাছে তিন মাসের মধ্যে হস্তান্তরের রায় দেন আদালত। একইসাথে কোম্পানির এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আগে কোম্পানির অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করতে চাটার্ড একাউন্ট ফার্ম হুদা ভাসি চৌধুরি অ্যান্ড কো. (এইচভিসি)কে নিয়োগ দেন হাইকোর্ট। অডিটের সকল খরচ দুই ভাইকে বহন করতে বলা হয়েছে।
রায়ে আদালত বলেন, "বর্তমানে কোম্পানি পরিচালনায় মতের অমিল হওয়ায় বড় ভাই সৈয়দ হোসেন এবং ছোট ভাই উজ্জ্বল এর মধ্যে সম্পর্ক চরম অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, দুজনের পক্ষে আর একসাথে কোম্পানির স্বার্থে কাজ করা অসম্ভব। আমাদের মতে, এ অচলাবস্থা থেকে কোম্পানিকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ার অধিকারীগণ কর্তৃক দরখাস্তকারীর শেয়ার ক্রয় করা।"
আদালত আরো বলেন, "অত্র কোম্পানি দরখাস্ত, উভয়পক্ষের সকল হলফনামা এবং সংযুক্ত সকল নথী পর্যালোচনায় আমার নিকট এটি কাঁচের মত পরিষ্কার যে, আমাদের কোম্পানি আইনটি ১০৯ বৎসরের পুরনো হওয়ার কারণেই অস্ত্র বিরোধের উদ্ভব হয়েছে।"