আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে চট্টগ্রামে স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ
চট্টগ্রামের বিশেষায়িত বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। নগরীর চট্টেশ্বরী সড়কের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের প্রধান ছাত্রাবাসের উত্তর পাশের (গোয়াছি বাগান নামে পরিচিত) জমিটিকে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
উপযুক্ত জমি না পাওয়ায় দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর ঝুলে ছিল ১০০ শয্যার বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ বার্ন হাসপাতাল নির্মাণ উদ্যোগ। প্রকল্পটির নকশা প্রণয়ন ও বাজেট তৈরির কাজ চলছে। আগামী ১০ মার্চ চীন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
দেশের সকল বার্ন চিকিৎসা সম্প্রসারণে প্রকল্পের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জমি নির্ধারণ জটিলতার কারণে দীর্ঘদিন থমকে ছিল উদ্যোগটি। এরপর চীনে কোভিডের প্রকোপ বাড়ায় ধীর গতি আসে। এখন সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়েছে। জমিও নির্ধারণ চূড়ান্ত। নকশা ও প্রাক্কলন প্রণয়নের কাজ শেষ। প্রকল্পের দাতাসংস্থার প্রতিনিধিরা (চীন সরকার) ২৬ ফেব্রুয়ারি সফরে আসছেন। চট্টগ্রাম পরিদর্শনের পর আগামী ১০ মার্চ সমঝোতা স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অবকাঠামো সংক্রান্ত সভায়ও বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে চীনা কর্তৃপক্ষের চিঠি চালাচালি হয়েছে।"
আজ (২৬ ফেব্রুয়ারি) চীন সরকারের ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। একজন স্থপতির নেতৃত্বে চীনা এ টিমে থাকছেন এয়ার কন্ডিশন এন্ড ভেন্টিলেশন ইঞ্জিনিয়ার, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, অনুবাদক এবং জিওলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তারা। ২৮ ফেব্রুয়ারি চীন দূতাবাসের কর্মকর্তাসহ প্রতিনিধি দলটি চট্টগ্রামে যাবেন। ৯ দিনের সফরে প্রস্তাবিত স্থানে জরিপ, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সুবিধা, যোগাযোগ সুবিধাসহ সার্বিক দিক পর্যালোচনা করার কথা রয়েছে। সার্বিক কার্যক্রম শেষে ৯ মার্চ তারা ঢাকায় ফিরবেন। ১০ মার্চ এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান টিবিএসকে বলেন, "চীনা কর্তৃপক্ষ ৩১০০ স্কয়ার মিটার জমি চেয়েছে। আমরা জমি দিতে প্রস্তুত। সেখানে অনুমোদনহীন কিছু ঘর-বাড়ি রয়েছে। তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারা চলে যাবেন।"
তিনি আরো বলেন, "চীনা প্রতিনিধি দলের সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আমরা গত বৃহস্পতিবার প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করেছি। ৯ দিনের সফরে তারা সব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কাজ করবেন।"
চমেক হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এলাকায় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সম্ভাব্য জমি পরিদর্শনে আসেন চীন সরকারের একটি প্রতিনিধি দল। ওই সময় চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পেছনের খালি জমি নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশস্থ চীনা দূতাবাস বিশেষায়িত ১০০ শয্যার স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিট করার আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রায় চার হাজার বর্গফুট জমিতে চারতলা বিশিষ্ট ১০০ শয্যার বিশেষায়িত ইউনিট নির্মাণের নকশা তৈরি করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে প্রয়োজনের তুলনায় কম জমি থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়।
জটিলতা নিরসনে ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ চীনা প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সুরহা না হওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন চীনের প্রতিনিধিরা। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও একাধিকবার আলোচনা প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনের বিষয়ে চীন কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে পারেনি। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ২০২০ সালের জুলাইয়ে চীন সরকারের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে 'বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ বার্ন হাসপাতাল' নির্মাণের বিষয়ে আবারও প্রস্তাব দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত। এর ভিত্তিতে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাম্ভাব্য চারটি স্থানের প্রস্তাবনা দেয়।
গত বছরের জুনে সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়। এ ঘটনায় রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খান চিকিৎসকেরা। তখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বার্ন ইউনিট নির্মাণের বিষয়ে জোরালো আলোচনা হয়। ওই বছরের ১১ জুন চীনা প্রতিনিধি দলের দুই প্রকৌশলী প্রস্তাবিত জমি পরিদর্শন করেন। এটিকে চূড়ান্ত করে নকশা প্রণয়নের কাজও শেষ পর্যায়ে।
চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটটি ২৬ শয্যার। চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম বিভাগের ৯টি জেলার প্রায় ৪ কোটি মানুষ নির্ভর করেন এই বার্ন ইউনিটের উপর। চমেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমদ টিবিএসকে বলেন, "এখানে রোগীর চাপ অনেক বেশি। ২৬ শয্যার ইউনিটে প্রতিদিন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া জরুরি বিভাগে ২৫-৩০ জন এবং আউটডোরে ৩০-৪০ জন রোগী চিকিৎসা নেন প্রতিদিন।"
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান টিবিএসকে বলেন, "অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইনফেকশন কন্ট্রোল (সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ)। কিন্তু এখানে একটি সাধারণ ওয়ার্ড রয়েছে। ১৯৫৭ সালের অপারেশন থিয়েটার দিয়ে চলছে। আইসিইউ নেই। শয্যা সংকট রয়েছে। হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে থাকেন অনেক রোগী। ইনফেকশন কন্ট্রোলের কোন ব্যবস্থা নেই। নতুন ইউনিটে ইনফেকশন কন্ট্রোলের ব্যবস্থা থাকবে। স্বতন্ত্র অপারেশন থিয়েটার ও আইসিইউ থাকবে। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রদান সম্ভব হবে।"