যুদ্ধে লাভবান কোম্পানিগুলোর উচিত বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া: জি-২০ বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যেসব কোম্পানি পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে, তাদের উচিত এই যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্প উন্নত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া- নয়াদিল্লীতে গণমাধ্যম সিএনবিসির সাংবাদিক তানভির গিলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
ভারতে গতকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে দুদিনব্যাপী অর্থনৈতিক জোট জি-২০ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও যোগ দিয়েছেন।
সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "এই যুদ্ধের ফলে জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতের কিছু কোম্পানি পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে। তাই লাভবান এ কোম্পানিগুলোর প্রতি আমাদের দাবি, কোম্পানিগুলোর লাভের ২০ ভাগ যাতে তারা যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের মত দেশগুলোকে প্রদান করে।"
যদিও ড. মোমেন নির্দিষ্ট করে কোনো কোম্পানির নাম উল্লেখ করেননি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর এবার আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে এমন দাবি করলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিশ্বব্যাংক ধারণা করছিল, যুদ্ধের ফলে গতবছর ইউক্রেনের অর্থনীতির পরিসর শতকরা ৩৫ ভাগ সংকুচিত হয়ে আসবে।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত দেশ, যারা কি-না মোট চাহিদার বেশিরভাগ জ্বালানিই আমদানি করে থাকে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ মোট চাহিদার প্রায় ৯৫ ভাগ জ্বালানি আমদানি করে থাকে।
মোমেন বলেন, "সাধারণত আমরা দেশের বাইরে থেকে জ্বালানী কিনে থাকি। বর্তমানে জ্বালানির দাম প্রচুর বেড়েছে। যার ফলে দেশের মুদ্রাস্ফীতিও বেড়েছে। আমরা ভর্তুকি দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।"
"এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা চাই যুদ্ধ বন্ধ হোক। আমরা আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাসী।"
ড. মোমেন মনে করেন, জি-২০ জোটের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর উচিত স্বল্প উন্নত দেশগুলোর প্রাপ্য এ 'বাধ্যতামূলক' ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "এরা জি-২০ জোটের নেতা, তারা বিশ্বের নেতা। আমি যদি ক্ষতিপূরণের দাবি করি, তাহলে কেউ তা পাত্তা দেবে না। কিন্তু জি-২০ জোটের নেতারা দাবিটি করলে তা কাজে আসবে। তারা যুদ্ধের ফলে লাভবান কোম্পানিগুলোকে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করতে পারেন।"
গতবছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এ যুদ্ধ।
যুদ্ধ শুরুর পর জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়, কোভিড মহামারির ফলে যেসব উন্নয়নশীল দেশ ইতোমধ্যেই ঋণে জর্জরিত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও শোচনীয় হবে।
রিপোর্টে বলা হয়, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। যা মুদ্রাস্ফীতির চাপকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। একইসাথে করোনার ধাক্কাকে কাটিয়ে উঠতে যে প্রবৃদ্ধির আশা করা হচ্ছিলো, সেটাও পূরণ হচ্ছে না। দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।"
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, "বহু উন্নয়নশীল দেশ ইতোমধ্যেই ঋণের চাপে ফলে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। যুদ্ধের বাড়তি প্রভাব হিসেবে 'ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট' ও আর্থিক চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে দেশগুলোর ঋণ সংক্রান্ত ঝুঁকির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।"
চলতি বছরের জানুয়ারিতে চলমান অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে আইএমএফ এর কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।
সংস্থাটি বর্ধিত ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায় বাংলাদেশকে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে।
আর এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে 'রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফান্ড'র আওতায় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কাজে সহযোগিতার অংশ হিসেবে আরও ১.৪ ডলার ঋণ দেবে আইএমএফ।
ইতোমধ্যেই ৪.৭ বিলিয়নের এ ঋণের ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার হাতে পেয়েছে বাংলাদেশ।
আইএমএফ এর পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, "বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনা মহামারির ক্ষতি দ্রুতগতিতে কাটিয়ে উঠছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে দেশটি অর্থসংকটে পড়েছে। বাংলাদেশে টাকার মান কমে গিয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে।"
খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানান, বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছে। তিনি মনে করেন, জি-২০ নেতাদের উচিত এ অবস্থাকে সামাল দেওয়া।
একইসাথে, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা নিয়েও কথা বলেন ড. মোমেন। তিনি মনে করেন, এ নিষেধাজ্ঞার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, "এ যুদ্ধের ফলে সাপ্লাই চেইন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।"
রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গে ড. মোমেন আরও বলেন, "ভবিষ্যতে আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে এর আগে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে আগে তাদের আলোচনা করা উচিত। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে আমরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবো এবং আমাদের এ ক্ষতি কীভাবে পূরণ করা হবে সে সম্পর্কে তাদের উদ্যোগ নিতে হবে।"
শিল্পোন্নত দেশগুলোর জি-২০ জোটে বাংলাদেশ সদস্য নয়। তবে জোটটির আসন্ন সম্মেলনের আয়োজক দেশ ভারত সদস্য দেশগুলোর বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মোট নয়টি দেশকে 'অতিথি দেশ' হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের 'অতিথি দেশের'র মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।