খরচ বেড়ে যাওয়ায় কমেছে হজযাত্রী, লোকসানে হজের সঙ্গে জড়িত ব্যবসা
এ বছর স্ত্রীকে নিয়ে হজে যাওয়ায় পরিকল্পনা করেছিলেন রাজশাহীর খলিলুর রহমান। কিন্তু আগের বছরের তুলনায় এবার হজের খরচ প্রায় দেড় লাখ টাকা বেড়ে যাওয়ায় সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে তাকে।
কোরবানি বাদে এ বছর বেসরকারি সংস্থাগুলোর অধীনে হজের খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা; কিন্তু এর বিপরীতে খলিলুর রহমানের বাজেট ছিল ৫ লাখ টাকার মধ্যে।
খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে শুধু খলিলুর রহমান একাই নন, হজের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন আরও অনেকেই। ব্যাপক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও, বুধবার পর্যন্ত হজযাত্রায় বাংলাদেশের ১.২৭ লাখ কোটার বিপরীতে নিবন্ধন করেছেন মাত্র ৬৬ হাজার ৮১০ জন, যা কোটার বিপরীতে প্রায় ৫৩ শতাংশ। তিনবার সময় বাড়ানোর পরে এ পর্যায়ে এসে ঠেকে নিবন্ধনের সংখ্যা।
হজ এজেন্সি ও ট্রাভেল এজেন্টদের মতে, বাংলাদেশ ও সৌদি আরব উভয় দিকেই ব্যয় বেশি হওয়ায় মোটের ওপর খরচ বেড়েছে।
উচ্চ বিমান ভাড়ার জন্য মূলত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে দায়ী করেছে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। তারা বলছে, হজ প্যাকেজের মোট ব্যয় বৃদ্ধিতে বিমান ভাড়ার ভূমিকা রয়েছে।
উচ্চ বিমান ভাড়া ছাড়াও, হজ এজেন্সিগুলো খরচ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে, সৌদি রিয়ালের বিনিময় হার ২৮.৩৪ টাকা, যা আগের বছরের ২৪.৩০ টাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
নিবন্ধনের সময় শেষ হবে আগামী ১৬ মার্চ। মঙ্গলবার (৭ মার্চ) ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এরপর আর সময়সীমা বাড়ানো হবে না।
এদিকে, হজ এজেন্সিগুলো বলছে, এই প্রথমবারের মতো হজযাত্রীদের কোটা পূরণে ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ। এর ফলে হজের সঙ্গে জড়িত ব্যবসাগুলো প্রভাবিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
"আমি হজ করার জন্য প্রি-রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম। এখন দেখছি, নির্ধারিত হজ প্যাকেজসহ সমস্ত খরচের জন্য প্রয়োজন ৮ লাখ টাকা; সেই হিসেবে আমি এবং আমার স্ত্রী- আমাদের দুজনের মোট খরচ হবে ১৬ লাখ টাকা," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান খলিলুর রহমান ।
"মোট খরচ ১০ থেকে ১১ লাখ টাকা হলে আমরা দুজনেই এবার হজে যেতে পারতাম। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা এখন ওমরাহ করার পরিকল্পনা করছি," যোগ করেন তিনি।
হজ এজেন্সি অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে ওমরাহর বর্তমান খরচ জনপ্রতি দেড় থেকে ২ লাখ টাকা।
সৌদি আরবের মক্কা শহরেই ওমরাহ পালন করা হয়। তবে বছরের যেকোনো সময়েই পালন করা যায় ওমরাহ। অন্যদিকে, ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হজ পালন করতে হয় বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে।
হজ মূলত একটি সপ্তাহব্যাপী ইসলামিক অনুষ্ঠান; আর্থিকভাবে সক্ষম মুসলমদের জীবনে অন্তত একবার হজ পালনের নিয়ম রয়েছে।
হজ এজেন্সি আত-তিয়ারা ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী আকবর আলী জানান, কোভিডের আগে প্রতি বছর তিনি প্রায় হাজারখানেক যাত্রী হজে পাঠাতেন। কিন্তু এ বছর তার এজেন্সির মাধ্যমে মাত্র ৩০০ জন আগ্রহী হজযাত্রী নিবন্ধন করেছেন।
"যদি সময়সীমা বাড়ানো হয়, আমরা এ বছর সর্বোচ্চ ৫০০ জন আগ্রহী হজযাত্রী পেতে পারি। খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই হজের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে, ওমরাহতে যেতে চাচ্ছেন," টিবিএসকে তিনি বলেন।
কোভিডের আগের তুলনায় সৌদি আরবের দিকেও খরচ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, "গত বছর কোভিড পরিস্থিতিতে সৌদি আরব খরচ বাড়িয়ে প্রায় ৮,০০০ রিয়াল করেছিল। এবারও এই খরচ খুব একটা কমানো হয়নি। এ বছর দেশটি খরচ নির্ধারণ করেছে প্রায় ৬,০০০ রিয়াল (প্রায় ১.৮০ লাখ টাকা); অথচ কোভিডের আগে এ খরচ ছিল সর্বোচ্চ ২,৫০০ রিয়াল।"
তিনি আরও জানান, "এবার বাংলাদেশ বিমান বিমান ভাড়া নির্ধারণ করেছে প্রায় ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, যা গত বছর ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।"
দুই দিকেই খরচ কমানো যেত উল্লেখ করে আকবর আলী বলেন, "বিমান ভাড়া যদি দেড় লাখ টাকা হতো, তাহলে প্রায় ৫০ হাজার টাকা সাশ্রয় হতো। আর যদি সৌদি আরবে খরচ ৩,০০০ রিয়াল (প্রায় ৯০,০০০ টাকা) কমানো হত, তাহলে প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো সাশ্রয় করে আমরা গতবারের খরচেই প্যাকেজ নির্ধারণ করতে পারতাম।"
তিনি বলেন, "যদি ভাড়া কমানো না হয় এবং এরজন্য যদি মানুষ হজে না যায়, তাহলে বিমান কীভাবে ব্যবসা করবে?"
সৌদি আরবের দিকে হজের প্রধান খরচ হলো- সার্ভিস চার্জ, মক্কা রুট সার্ভিস, ভিসা ফি এবং পরিবহন সেবা খরচ।
গত বছরের ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকার তুলনায় এ বছর সৌদি আরবে থাকার খরচ বেড়ে ২ লাখ ৪ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
স্টেকহোল্ডারদের মতে, বাংলাদেশের হজ এজেন্সিগুলো মূলত হজযাত্রীদের এই আবাসন ফি থেকে টাকা আয় করে। তারা হজযাত্রীদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ বেশি নিলেও গড়পড়তা হোটেল সেবা সরবরাহ করে থাকে।
এদিকে, হাবের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাওলানা এয়াকুব শরাফতি টিবিএসকে বলেন, "এখানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে।"
এ বছর তারা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করতে পারবেন বলেই আশা প্রকাশ করেন তিনি।
হাবের মহাসচিব ফারুক আহমেদ সরদার টিবিএসকে জানান, "যারা হজ করতে সৌদি যান, তারা সেখানে খরচ করার জন্য সাথে করে রিয়াল নিয়ে যান। রিয়াল ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও এবার মানুষের নিরুৎসাহিত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ।"
বিমান ভাড়া বৃদ্ধি
হজের জন্য প্রায় অর্ধেক যাত্রী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পতাকাবাহী ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইটে ভ্রমণ করেন এবং বাকি যাত্রীরা সৌদিয়া ও ফ্লাইনাসের ফ্লাইটে করে সৌদি আরবে যান।
হজ প্যাকেজের জন্য শুধু বিমান ভাড়াকে দায়ী করার সমালোচনা করে বিমান বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম টিবিএসকে বলেন, "১৬ ধরনের খরচ নিয়েই সম্পূর্ণ হজ প্যাকেজ। যারা শুধু বিমান ভাড়াকে দায়ী করছেন, তাদের মতো আমরা হোটেল ভাড়া বৃদ্ধিকেও দায়ী করতে পারি; কিন্তু তা করা উচিত নয়, কারণ খরচ বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ রয়েছে।"
"২০২৩ সালে মার্কিন ডলারের বর্ধিত বিনিময় হার, জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধি এবং উভয় দেশের সরকার নির্ধারিত ট্যাক্স বৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে এ বছর হজযাত্রীদের জন্য বিমানভাড়া ১.৯৭ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা ধর্মমন্ত্রণালয়, হজ এজেন্সি এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সবার মতের ভিত্তিতেই ঠিক করা হয়েছে," যোগ করেন তিনি।
কোনোভাবেই বাজার মূল্যের চাইতে বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, "শুরুতে ২.১০ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হলেও পরে সবার সুপারিশে সেটি আরো কমিয়ে আনা হয়।"
বর্তমান আর্থিক সংকটের সময় বিমানের জন্য লোকসানে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।