‘৭১ এর গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের সম্পৃক্ত করার আহ্বান বিশিষ্টজনদের
দেশি-বিদেশি 'রাজনীতির' কারণেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি স্বাধীনতার ৫০বছর পরেও বৈশ্বিক পরিসরে সামনে আসেনি বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
এমতাবস্থায় স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের পাশাপাশি লেখক, গবেষক, সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট সবাইকে সক্রিয়ভাবে তৎপরতার চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
"গণহত্যা নিয়ে একটি রাজনীতি আছে। রুয়ান্ডা, বসনিয়ার গণহত্যা সম্পর্কে সবাই জানলেও আমাদেরটা বিস্মৃত হলো কেন? এর রাজনীতিটা হচ্ছে, যখন এই যুদ্ধটি হয় তখন বাংলাদেশের পক্ষে চীন, আমেরিকার মতো সুপারপাওয়ার বা তথাকথিত মুসলিম বিশ্ব কেউ ছিল না," শনিবার (২৫ মার্চ) এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন এ কথা বলেন।
"সে অবস্থায় লুঙ্গি পরা কিছু মানুষ তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিল। এই বিষয়টা কেউ মেনে নিতে পারেনি," যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর ঢাকা গ্যালারিতে আয়োজিত 'গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মানবাধিকার প্রশ্ন'- শীর্ষক ওই বৈঠকে মুনতাসির মামুন আরও বলেন, "একাডেমিয়া থেকে শুরু করে রাজনীতি- সব জায়গায় একটি ঐকমত্য হয়েছিল যে, এ বিষয়টি আলোচনায় আনা যাবে না। আলোচনায় আসলে প্রশ্ন আসবে কে সাহায্য করেছিল।"
অভ্যন্তরীন রাজনীতির বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, "১৯৭৫ সাল থেকে ২৫ বছর বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি গণহত্যাকে সামনে আনতে চায়নি। তাদের আঁতাত ছিল ঘাতকদের সঙ্গে। তাই তারা যদি গণহত্যার কথা বলেন, তাহলে ঘাতকদের কথা চলে আসে।"
"সুতরাং এটি হারিয়ে গেল। মানে দেশ-বিদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতির কারণে এটি হারিয়ে গেল," যোগ করেন তিনি।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সরকারকেই দায়ী করেন জাতীয় পার্টির আইনপ্রণেতা কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি।
এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কী ভূমিকা পালন করেছে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, "এরজন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি দায়ী। তারা ২০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এটি করতে পারেনি।"
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদকর্তৃক গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের পর ২৫ মার্চ বাংলাদেশে জাতীয় 'গণহত্যা দিবস' হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটি সপ্তমবারের মতো পালিত হলো দেশে।
স্বীকৃতি আদায় না হওয়ার জন্য আত্মসমালোচনার আহ্বান জানিয়ে শহীদ তনয় আসিফ মুনির বলেন, "আমরা শুধু ২৫ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বর দিবস পালনের মধ্যেই এটি চিন্তা করি। এজন্য দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত কোনো অবস্থান আমাদের নেই।"
যথাযথ ডকুমেন্টেশনসহ আন্তর্জাতিক পরিসরে লবির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, "আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলগুলোকে স্বীকৃতির জন্য কর্মকৌশল ঘোষণা করতে হবে।"
কালচার অব ইমপিউনিটিকে দায়ী করে ব্যারিস্টার তানিয়া আমির বলেন, গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিচার হয়নি।
এজন্য একটি মক ট্রায়াল শুরু করে সেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের লোকদের সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
মক ট্রায়ালের ধারণা সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, "গণহত্যার বিষয়টিকে বিশ্বে জিইয়ে রাখার জন্য মক ট্রায়াল খারাপ না। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের মধ্যে এটি ধরে রাখার জন্য পাঠ্যক্রমসহ কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটিও ভাবতে হবে।"
সরকারের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবীসহ সবাইকে যার যার দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তিনি।
স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সরকারকে সক্রিয়ভাবে কাজ করার আহ্বান জানান সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের কৌশল হিসেবে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবিব বলেন, "বিভিন্ন দেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদেরকে এই বিষয়ে যুক্ত করতে হবে।"
তবে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের মিশনগুলোতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত ডকুমেন্টেশন নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের সভাপতি মোজাম্মেল বাবুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান, বীর বিক্রম ও মানবাধিকার কর্মী রোকেয়া কবির।