উপজেলা পরিষদে ইউএনওদের ক্ষমতা কেড়ে নিলেন হাইকোর্ট
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিধান অবৈধ এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
এই রায়ের ফলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে সাচিবিক সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
রায়ে একইসঙ্গে 'উপজেলা প্রশাসন' ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে এখন থেকে আর উপজেলা প্রশাসন ব্যবহার করা যাবে না। আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদ ব্যবহার করতে হবে।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট এ সংক্রান্ত রুল জারি করেছিলেন। দুটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি করে বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি, হাসান এম এস আজিম ও আইনজীবী মো. মিনহাদুজ্জামান লিটন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, হাইকোর্ট বুধবার সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেছে। পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিতক হলে এর বিরুদ্ধে আপিল করবে সরকার।
উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সাচিবিক দায়িত্ব পালনের বিধানসংবলিত আইনের ৩৩ ধারা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে এর আগে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।
এছাড়া ইউএনওরা বিভিন্ন আমন্ত্রণপত্রে উপজেলা পরিষদ না লিখে উপজেলা প্রশাসন লিখে থাকেন, এটাও কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং বিভিন্ন কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সভাপতি এবং চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করতে জারি করা পরিপত্র কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রুল জারি করেছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব, স্থানীয় সরকার সচিবসহ ১৫ সচিবকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম।
এর আগে উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু, উপজেলা চেয়ারম্যান রিনা পারভীন, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মেদ ও ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার বাদী হয়ে ওই রিট করেন।
রিট দায়েরের পর ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম বলেছিলেন, 'উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়েছে। আইনের ৩৩ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে- উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হইবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবেন। ৩৩-এর (২) উপধারায় বলা হয়েছে- পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কার্যাবলি পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করিবেন।'
এই আইনজীবী আরও বলেছিলেন, 'পরিষদ কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তা ইউএনও বাস্তবায়ন না করলে পরিষদের করণীয় কিছু থাকে না। কারণ উপজেলা পরিষদের কাছে ইউএনওর জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা আইনে রাখা হয়নি। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে এই একটি ধারার মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই ৩৩ ধারা সংবিধানেরও ৭ ও ৫৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। ৫৯ (১)-এ স্থানীয় শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে- আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।'
ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম আরও বলেছিলেন, 'মাঠ প্রশাসন কোনো চিঠিপত্র লিখলে বা অনুষ্ঠান করলে দাওয়াতপত্র বা ব্যানারে উপজেলা পরিষদ না লিখে লিখছে উপজেলা প্রশাসন। এই 'উপজেলা প্রশাসন' কোথাও উল্লেখ নেই। এর মাধ্যমে ইউএনওরা স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া সরকারি কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে যতগুলো কমিটি গঠন করা হয়, তার সবগুলোতে ইউএনওকে চেয়ারম্যান করা হয় এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের করা হয় উপদেষ্টা।
আবার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ থাকে, ইউএনও ইচ্ছে করলেই আরও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। এমনই অনেক ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের হিসাবও তাদের দেওয়া হয় না। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও স্থানীয় সরকার পদ্ধতির চেতনার পরিপন্থি।