প্রবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের ডাক: তোমরা আস, কাজ কর, মুক্ত কর বাংলাদেশকে
প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের ডাক
মন্দবাগ, কুমিল্লা
বাংলাদেশ; ১৮ অক্টোবর, ১৯৭১
বন্ধুগণ,
কঠোর কাঠফাটা রোদ আর কাক ডাকা দুপুর। বাংলাদেশের বিভিন্ন রণপ্রান্তর ঘুরে আমি আবার ফিরে এসেছি মন্দবাগে। মন্দবাগের সঙ্গে আমাদের আত্মার সংযোগ রয়েছে। মন্দবাগের যুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছে সতের বছরের ছেলে জাকের এবং আরও অনেকে। ভবিষ্যতে মন্দবাগ রেলওয়ে ষ্টেশনের নাম হবে 'জাকের ষ্টেশন'। এর অদূরে শালনা'র কূলে এক ছোট পাহাড়ের ঢালে গত মাসে সমাহিত করেছি আমাদের চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর সেনানীকে। ভদ্রলোক বিদেশি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। দখলীকৃত বাংলাদেশের বৈদ্যুতিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংসের ব্যাপারে তিনি সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন ম্যাপ, চার্ট ইত্যাদি দিয়ে। ইয়াহিয়ার জঙ্গিবাহিনী তাকে ধরার চেষ্টা করলে, মুক্তিবাহিনী তাঁকে ঢাকা থেকে মুক্ত এলাকায় নিয়ে আসে নিরাপত্তার জন্য। মুক্তবাংলায় এসে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলেন। ডাক্তার মবিন ও নাজিমের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি মারা গেলেন উপযুক্ত ওষুধ-পত্রের অভাবে।
অদূরে আমাদের 'বাংলাদেশ হাসপাতাল'। এটাই বাংলাদেশের মুক্তিসেনানীর প্রথম হাসপাতাল। এর স্থাপনে আমাদের বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ অবদান রয়েছে। তবে হাসপাতাল তৈরির সব কৃতিত্ব ডাক্তার মবিনের। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, মবিন আমাদের সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক। গত মে মাস থেকে মবিন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে। তার অপূর্ব ত্যাগ ও অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যতিরেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র চিকিৎসালয় স্থাপন সম্ভব হতো না। হাসপাতালে বর্তমানে একশতজন অসুস্থ মুক্তিসেনানী রয়েছে। ত্রিশজন গ্যাসট্রো এনটাইটিস, পেপটিক আলসার, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া ও নিউমোনিয়ায় ভুগছে। বাকি সব আহত মুক্তিযোদ্ধা। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রোডস্থ সিএন্ডবি ব্রিজ সন্নিকটস্থ এক সংঘর্ষে আহত হয়ে আসা মুক্তিসেনানী আজও ভর্তি হয়েছে। ঐ সংঘর্ষে আমরা চারজন নির্ভীক বীরকে হারিয়েছি, কিন্তু খতম করেছি পনের জন দস্যুসৈন্য, ৫৭ জন রাজাকার। হাসপাতালে ফিরতে আমার সংকোচ হচ্ছে। একটুকু এনালজেসিক নেই, নেই সামান্যতম ড্রেসিং। দু'সপ্তাহ যাবৎ থান কাপড় কেটে ড্রেসিং হিসেবে ব্যবহার করছিলাম। এখন তাও ফুরিয়ে গিয়েছে—আশপাশের অঞ্চলে থান কাপড়ও পাওয়া যাচ্ছে না। যথাযোগ্য অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থা নেই। হানিফের উন্ডটা ইনফেকটেড (infected) হয়েছে। ষোল বছরের ছেলে হানিফ ঢাকার গুলবাগ বৈদ্যুতিক সরবরাহ কেন্দ্র উড়িয়ে দিয়ে ফেরার পথে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে আহত হয়। Compound Tibia-Fibula Fracture নিয়ে সাত দিন পরে আমাদের হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়।
চারদিকে অভাব আর অনটন। প্রয়োজন আর প্রয়োজন। প্রয়োজনের তাগিদ যেন আহ্বান জানাচ্ছে প্রবাসী বাঙালি ডাক্তারদের কাছে—তোমরা আস, কাজ কর, মুক্ত কর বাংলাদেশকে। আমার নিজের মনে আজ প্রশ্ন জাগছে—আমরা যাঁরা বিদেশে আছি, তাঁরা সবাই চেষ্টা করলে কি প্রয়োজনীয় Analgesics, Antibiotics, Dressing & Preventive Drugs-এর ব্যবস্থা করতে পারি না?
২৮ শে সেপ্টেম্বর '৭১ ইং। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী আমাদের হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। কর্নেল ওসমানী অসাধারণ স্মরণশক্তির অধিকারী। তার সঙ্গে বিশ বছর আগেও যাঁরা কাজ করেছেন, তাদের সবার নাম তাঁর মনে আছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিটি সৈনিককে তিনি চিনেন। তিনি আহার-নিদ্রা ভুলে থেকে ঝড়-বৃষ্টি, শত্রুপক্ষের অবিশ্রান্ত গোলাবর্ষণ অগ্রাহ্য করে তিনি পরিদর্শন করছেন বিভিন্ন রণাঙ্গন — উৎসাহিত করছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। হাসপাতাল দেখে তিনি খুশি হলেন। কিন্তু ওষুধপত্রের অভাব দেখে তার চোখে-মুখে যে বেদনার উদ্রেক হয়েছিল, তা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।
হাসপাতাল দেখে কর্নেল ওসমানী বললেন — 'আমি এরূপ আরও দশটি হাসপাতাল চাই। আপনি চলুন আমার সাথে। হাসপাতালের জন্য স্থান নির্বাচন করবেন। বিলেত থেকে আরও দশজন সার্জন ও দশজন এনাসথেটিককে আসার জন্য লিখে দিন।' মনে মনে ভাবলাম মাসিক ২০০/২৫০ পাউন্ডের মায়া ছেড়ে বিশজন ডাক্তার কি বাংলাদেশের এ কঠোর ও প্রতিকূল অবস্থায় কাজ করতে আসবেন?
কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে এসেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের সেক্রেটারি ডা. টি. হোসেন এবং অসমসাহসী সেনাপতি (কর্নেল) খালেদ মোশাররফ। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিলেন জঙ্গিশাহী ইয়াহিয়া-নরপশুদের মনে। দলের সঙ্গে আমি 'কোণারন' গেলাম। সেখানে দেখা হলো ক্যাপ্টেন গাফফারের সঙ্গে, বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ যুবক। উপযুক্ত অস্ত্র নেই, উপযুক্ত খাদ্য নেই, তবু উৎসাহের শেষ নেই ক্যাপ্টেন গাফফারের। তিনি আমাকে দেখালেন সদ্যমৃত তিনজন পাঞ্জাবি সৈন্যকে।
সেক্টর হেডকোয়ার্টারে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের এ রুদ্রমূর্তি দেখলাম। আমাকে দেখে, সমস্বরে 'জয়বাংলা' বলে জড়িয়ে ধরলো বাদল, আলম, জিয়া খোকন, মায়া, বাসার, কাজী, সাইদ ও আরও অনেকে। এদের প্রত্যেকের নাম ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন বিজয় অভিযানের সঙ্গে জড়িত।
১৪ আগস্ট। তথাকথিত পাকিস্তানের জন্ম দিবস। পাশবিক আনন্দে মেতে উঠেছে নরপশুরা। এ দিনে চারজন তরুণ প্রবেশ করলো ঢাকার অভিজাত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তারা নরপশুদের সঙ্গে মিলে হৈ-হুল্লায় মেতে উঠলো। কে বলবে তারা মুক্তিবাহিনীর লোক। রাত যখন গভীর হলো, যুবকগুলো হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। আর কিছুক্ষণ পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধসে পড়লো হোটেলের এক বিরাট অংশ। চার যুবকের একজন কাজী।
১৯ আগস্ট। আগে থেকেই ঢাকার নাগরিকদের মুক্তিবাহিনী জানিয়ে দিয়েছিল, যে কোনো সময় ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঢাকার নাগরিকরা মোমবাতি ও হারিকেন নিয়ে প্রতিদিন প্রস্তুত থাকতো। ১৯ আগস্ট রাতে সে মুহূর্তটি এলো। ঢাকা শহর ও উপকন্ঠের বৈদ্যুতিক আলো নিভে গেল। অসুবিধার মধ্যেও ঢাকার নাগরিকদের মুখে হাসি ফুটলো।
২৯ আগস্ট। কাজীদের দলের কয়েকজন ধরা পড়েছে। তাদেরই একজন অত্যাচার সইতে না পেরে শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করে দিয়েছে সকলের নাম। গভীর রাতে কাজীর বাসা অবরোধ করলো পাঞ্জাবি নরপশুরা। কাজী ও তার তিন বন্ধু মেঝেতে ঘুমিয়ে ছিল। সার্চ করে, পাকিস্তানি সেনারা একটা চাইনিজ অটোমেটিক পিস্তল পেলো। কাজীদের দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করালো শেষ করে দেবার জন্য। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন অন্যরকম ছিল। কাজীর পায়ের কাছে একটা বালিশ ছিল। সে পা দিয়ে সেটা ঠেলে দিল সামনের দিকে। ক্ষণিকের জন্য শত্রুদের দৃষ্টিচ্যুত হলো। কাজী ক্ষিপ্রতার সাথে হাবিলদার থেকে স্টেনগানটা ছিনিয়ে নিয়ে খতম করলো চারটি নরপশুকে। কাজী যখন স্টেনগান নিয়ে বেরিয়ে এলো, তখন আরও তিনজন নরপশু একযোগে তাকে আক্রমণ করলো। সে ক্ষিপ্রতার সাথে তাদেরও খতম করলো। ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকার মগবাজারে। কাজীর দিকে তাকালাম। বাংলাদেশের সাধারণ এক যুবক। গর্বে আমার মন ভরে উঠলো। কাজী আবার প্রস্তুত হচ্ছে নরপশুদের হত্যার জন্য।
পশ্চিম সীমান্তে দেখা হলো মেজর মনজুরের সঙ্গে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রাজপুতনার মরুভূমি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেবার জন্য। দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া, রংপুরের পাটগ্রাম, ময়মনসিংহের তারাটিয়া খানা, রুমারী (বর্তমান রৌমারী), কোদালকাটি, চিলমারী ও হালুয়াঘাটের বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুকবলমুক্ত। ময়মনসিংহ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কর্নেল জিয়াউর রহমান। ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে তিনিই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেছিলেন।
উত্তর-পূর্ব সীমান্তে এক পর্যায়ে কর্নেল শফিউল্লাহ ও মেজর নূরুজ্জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। গত পরশু মুক্তিবাহিনী 'ছাতক' আক্রমণ করে বাংলাদেশের জয় পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে চলেছে। এন্টি-এয়ারক্রাফট গানের অভাব আমাদের মনোবল ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি।
স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গত ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রিপতি ৫,০০০ টাকা এবং প্রধানমন্ত্রী ২,০০০ টাকা মঞ্জুর করেন। তাঁরা আমাদের কাজের বিশেষ প্রশংসা করেন এবং মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য প্রবাসী উচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডাক্তারদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান। আমাদের শরণার্থীদের (Refuges) সম্পর্কে কিছু না লিখলে আমার এ চিঠি অসম্পূর্ণ থাকবে। মুজিবনগরের পথে বহু শরণার্থী শিবির দেখেছি। জঙ্গিশাহী ইয়াহিয়া চক্রের অত্যাচারের চিহ্ন বহন করে এনেছে প্রায় প্রতিটি বাস্তুহারা গৃহহীন মানুষের দল। ভারত সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে তাদের সাহায্য করার জন্য। কিন্তু যে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। হাজার হাজার শিশু, যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর পথে। চারিদিকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের দেশবাসী হাসিমুখে এত কষ্ট স্বীকার করে নিয়েছে। আর আমরা বাংলাদেশের ডাক্তাররা কি নির্বিকার, অথর্ব হয়ে থাকবো জাতির দুর্দিনে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। পাকিস্তানিদের মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। চরম আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে মুক্তিবাহিনী। জয় আমাদের হবেই। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের সম্মুখে বাধার প্রাচীর হয়ে থাকতে পারবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামে আজ অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ — নিজের সম্পদ-শক্তি দিয়ে সাহায্য করছে মুক্তিবাহিনীকে। প্রবাসী বাঙালিদের কী ভূমিকা হবে? আমরা কি আমাদের আয়ের শতকরা দশ ভাগের মায়া মুক্তি সংগ্রামের জন্য ত্যাগ করতে পারি না? শালদার তীরে শহীদ জাকের, জব্বার, আশরাফ, ইসলাম আরও অনেক নাম না জানা অমর সৈনিকদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এ বিদীর্ণ অপরাহ্ণে আমি সব প্রবাসী বাঙালিকে বিশেষত ডাক্তার বন্ধুদের আহ্বান করছি আরও সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য।
শুভেচ্ছা রইল।
ইতি
আপনাদের প্রীতিধন্য
জাফরুল্লাহ চৌধুরী