যশোরের বধ্যভূমিগুলো বেহালদশায়: মুছে যাচ্ছে পাক হানাদার আর রাজাকারদের নির্মমতার চিহ্ন
মহান মুক্তিযুদ্ধে যশোরের অন্যতম স্মৃতিচিহ্ন বধ্যভূমিগুলো বেহাল অবস্থায় রয়েছে। অযত্ন আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে এগুলো। অনেক বধ্যভূমির ওপর বাড়িঘরও গড়ে উঠেছে। '৭১-এর রক্তাক্ত ইতিহাসের মর্মন্তুদ স্মৃতিবিজড়িত অর্ধশতাধিক বধ্যভূমি রয়েছে প্রাচীনতম এ জেলায়।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশের আর সব স্থানের মতো গোটা যশোর জেলায় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা চালিয়েছিল নির্মম তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীসহ নিরীহ শত শত মানুষকে ধরে এনে বধ্যভূমিগুলোতে হত্যা করা হয়েছিল।
শহরের অন্যতম বধ্যভূমি শংকরপুর রায়পাড়া এলাকায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখান থেকে কয়েক ট্রাক মানুষের হাড়-কঙ্কাল উদ্ধার করে মিত্রবাহিনী ভারতে নিয়ে যায়।
এ বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলেও এটি অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে সারাবছর। প্রতিবছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। কিন্তু বছরের অন্য সময়গুলোতে এ বধ্যভূমির আর কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না।
এছাড়া যশোর শহর ও শহরতলিতে অন্তত ৫০টি বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিরামপুর, ধোপাখোলা, খয়েরতলা, যশোর সেনানিবাস, হর্টিকালচার সেন্টার, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, কোতোয়ালি থানা চত্বর, বকচর, মুড়লি মোড়, ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, রূপদিয়া, রূপদিয়া নীলকুঠি, রেলস্টেশন মাদরাসা, চৌগাছার ডাকবাংলো, কপালিয়া খেয়াঘাট, খাজুরা, বাঘারপাড়ার চিত্রা নদীর তীর, অভয়নগরের ভৈরব নদ তীর, কেশবপুরের মঙ্গলকোট ব্রিজ, সীমান্তের মাশিলা গ্রাম এবং শার্শা থানার বধ্যভূমি।
শংকরপুর রায়পাড়ার বধ্যভূমির প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে এনে এখানে হত্যা করা হতো। ট্রেনে করেও অসংখ্য মানুষকে এখানে আনা হয়েছিল। সে সময় ওই এলাকা ছিল বনজঙ্গলঘেরা এবং নির্জন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে শংকরপুরের বধ্যভূমির উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শংকরপুরের সরকারি হাঁস-মুরগি খামারে শত শত বাঙালিকে ধরে এনে জবাই করে হত্যা করেছিল বিহারিরা। খামারের বিভিন্ন শেড ও পাম্প হাউজের পাশে এবং কুয়ায় তাদের লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল।
বকচর এলাকার নটবর বাবুর বাঁশবাগানে বিহারিরা কয়েকশ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। ধোপাখোলায় দুই রাজাকারকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা ২৩ জন বাঙালিকে হত্যা করে।
সরকারি তথ্য বাতায়নে ধোপাখোলা বধ্যভূমির বর্ণনায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বজিৎ গাঙ্গুলীর যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে গুলি চালানোর বীরত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
কথিত আছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বজিৎ তার থ্রি নট থ্রি বন্দুক দিয়ে বিমানবন্দরে অবতরণরত যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিলেন। সে গুলিতে বিমান বা বিমানের কোন আরোহীর কোনো ক্ষতি হয়নি।
সে সময়ের ধোপাখোলার আরবপুর ইউনিয়নে ছিল শান্তি কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল সলেমান মুন্সীর বাড়ি। এ গুলির ঘটনার পর তার চেনানো পথে রাজাকারেরা আক্রমণ করে ধোপাখোলায়।
বিরামপুরেও বেশ কয়েকটি গণহত্যা হয়। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর বিরামপুরের একটি কুয়া থেকে ১০টি মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। ভৈরব নদের দড়াটান ব্রিজের পাশেও বহু মুক্তিকামী মানুষের মৃতদেহ ফেলা হয়েছিল।
সূত্র জানায়, যশোর জেনারেল হাসপাতাল, বকচর, কোতোয়ালি থানা এবং রেলস্টেশন মাদরাসা এলাকার বধ্যভূমি সংরক্ষিত হলেও সেগুলো অযত্নে রয়েছে। অন্য বধ্যভূমিগুলোর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। অনেক জায়গায় গড়ে উঠেছে বাড়িঘর।
মুক্তিযোদ্ধারা এবং নতুন প্রজন্ম প্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির প্রতি এ স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লিবারেশন ফোর্স — মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের উপ-অধিনায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম বলেন, এ বধ্যভূমিগুলো বাঙালির সংগ্রামের চিহ্ন এবং পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের নির্মমতার সাক্ষী।
'এগুলো সংরক্ষণ করা না হলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে যাবে,' বলেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।