চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আটকা প্রবাসীদের পাঠানো ২৫ মেট্রিক টন পণ্য
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আবারো বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাগেজ রুলের আওতায় প্রবাসীদের পাঠানো কার্গো খালাস। গত ২ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ কোন লিখিত ঘোষণা ছাড়াই কার্গো খালাস বন্ধ করে দিয়েছে।
রমজান এবং ঈদকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠালেও কাস্টম খালাস না দেওয়ায় প্রবাসীরা সেগুলো খালাস নিতে পারছে না। এর ফলে গত মার্চ পর্যন্ত বিমানবন্দরের কার্গো হলে জমে আছে ৯০টি চালান। এতে পণ্য আছে প্রায় ২৫ মেট্রিক টন।
পণ্য খালাস নিতে না পারায় প্রতিদিন বাড়ছে বিমানবন্দরের ওয়্যারহাউস চার্জ। কার্গো হলে নষ্ট হচ্ছে পণ্য। পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে গেছে কার্গো উঠানামায় নিয়োজিত প্রায় শতাধিক শ্রমিক।
প্রবাসীদের পণ্য পাঠানোর বিষয়ে ব্যাগেজ রুলে যৌক্তিক পরিমাণের কথা উল্লেখ রয়েছে। ফলে প্রতিটি চালানে ৩৫০ কেজি ওজনের পণ্য পাঠাতো প্রবাসীরা। ব্যাগেজ রুলে কি পরিমাণ পণ্য নিয়ে আসতে পারবে সুনির্দিষ্ট সীমা না থাকলেও কাস্টমস অলিখিতভাবে ১০০ কেজির উপরে আসা পণ্য চালান খালাস বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে গত দেড় মাস ধরে আটকে আছে ১০০ কেজির উপরে আসা পণ্য চালান।
বিমানবন্দরের কার্গো শাখার তথ্য মতে, রমজান এবং ঈদকে ঘিরে প্রবাসীদের পণ্য পাঠানোর চাপ থাকে। রমজানকে কেন্দ্র করে প্রতি সপ্তাহে ৬০০-৭০০ চালান খালাস হয়। প্রতি চালানে থাকে প্রায় ৩৫০ কেজি। মাসে আয় হয় প্রায় ৩০ লাখ টাকা। বর্তমানে পণ্য আসা বন্ধ থাকায় আয় কমে গেছে। মার্চ মাসে ওয়্যার হাউসের চার্জ সহ আয় হয়েছে মাত্র ৩৬ হাজার টাকা।
এদিকে কার্গো খালাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ইমেজ সংকট তৈরী হচ্ছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। যেখানে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজ নির্মাণ প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে সেই বাস্তবতায় কার্গো খালাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই প্রকল্পটির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বলে জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশেন অর্গানাইজেশন বিমানবন্দরের সক্ষমতা নিরুপণ করে প্রতিবেদন দেয়। বিমানবন্দরের সক্ষমতার বড় একটি অংশ কার্গো পরিবহন, কার্গো ওয়্যারহাউসের সক্ষমতা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কার্গো খালাস বন্ধ থাকায় এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাসলিম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, কার্গো বন্ধ থাকার বিষয়টি বিমান সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। কার্গো খালাস বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্লাইট চালু এবং বিমানবন্দরের ইমেজের জন্য ইতিবাচক নয়।
প্রবাসী এবং সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্টরা জানিয়েছে, কাস্টমস কর্মকর্তাদের ইচ্ছামাফিক সিদ্ধান্তের কারণে কার্গো খালাস বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে বিমানবন্দরের ওয়্যার হাউস চার্জ বাবদ অতিরিক্ত চার্জ গুনতে হচ্ছে প্রবাসীদের। দীর্ঘদিন ধরে চলা একটি নিয়ম পরিবর্তন করে কাস্টমসের এমন সিদ্ধান্তের কারণে প্রবাসীদের পাঠানো পণ্য আটকে আছে।
দুবাই প্রবাসী নুরুল আবছার টিবিএসকে বলেন, 'আমি দুবাই থেকে গত জানুয়ারিতে দুধ পাউডার সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পাঠাই। গত ২ মার্চ দেশে আসি। কিন্তু চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে পণ্যগুলো খালাস নিতে পারিনি। সিএন্ডএফ এজেন্টের কাছে বারবার ধর্ণা দিলেও বলছে কাস্টমস পণ্য ছাড় করছে না। পণ্যগুলো আদৌ পবো কিনা সংশয়ে আছি।'
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার করে বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে আসছে একটি চক্র। গত মার্চে আমদানি নিষিদ্ধ কসমেটিকস সহ ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য নিয়ে আসার প্রমাণ কাস্টমস। এরপর কাস্টমস ১০০ কেজি ওজনের বেশি আসা পণ্য চালানের খালাস বন্ধ করে দেয়।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পণ্য খালাসের সাথে জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্টরা বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়মের সাথে জড়িত কাস্টমস সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। কারো অনিয়মের কারণে পুরো কার্গো সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়ার যৌক্তিকতা নেই।
সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী ইমাম হোসেন বলেন, প্রায় ১০০ প্রবাসীর ৩ মেট্রিক টন পণ্য গত কয়েকমাস ধরে আটকে আছে বিমানবন্দরের ওয়্যারহাউসে। রমজানকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা পণ্যগুলো পাঠালেও কাস্টমস খালাস না দেওয়ায় তাদের স্বজনরা সেসব পণ্য ব্যবহার করতে পারেনি। যেসব পণ্য আটকে আছে সেগুলো দ্রুত খালাস দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম শুরু হয় ২০০২ সাল থেকে। ২০০০ সালের তৈরী ওয়্যারহাউসে কার্গো ধারণ সক্ষমতা ২০০ মেট্রিক টন । চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আসা পণ্যচালানগুলোতে ৩৫০ কেজির বেশি পণ্য থাকে। একটি পণ্য চালানে থাকে একাধিক ব্যাক্তির পণ্য।
১০০ কেজি পণ্য চালান নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে কাস্টম জানায়, আইনে আছে যৌক্তিক পরিমাণ পণ্য নিয়ে আসতে পারবে প্রবাসীরা। তাই কাস্টম মনে করছে যৌক্তিক পরিমাণ ১০০ কেজি।
গত বছরের অক্টোবর থেকে কাস্টমস কার্গো খালাস বন্ধ করায় আটকে যায় ৫০০ প্রবাসীর পাঠানো প্রায় ২০০ মেট্রিক টন পণ্য। গত ১২ নভেম্বর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আটকে থাকা পণ্য চালান খালাসের অনুমতি দেয়। ডিসেম্বরে ওয়্যারহাউসের বিলম্ব মাসুলবাবদ বিমানবন্দরে আয় হয়েছিলো ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য মতে, ইমপোর্ট কার্গো থেকে ২০২২ সালের জুনে বিমানবন্দর কার্গো ওয়্যার হাউস থেকে ২৫,৫৪,৬৭৩ টাকা আয় করে। এছাড়া জুলাইতে ৩২,২২,৩৪২ টাকা, আগস্টে ২৯,৭৭,৭৬২ টাকা, সেপ্টেম্বরে ২১,৪৭,০৮৪ টাকা, অক্টোবরে ৯,৮৪,২৭১ টাকা, নভেম্বরে ১০,০৮,০৬৭ টাকা ডিসেম্বরে ১,৪৪৩৫,৬৪৪ টাকা রাজস্ব আয় হয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
এরপর জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে আয় নেমে আসে চার লাখ টাকায়। যেটি মার্চ মাসে আয় হয় ৪০ হাজার টাকা।
একইভাবে রাজস্ব আয় কমেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এয়ারফ্রেইট ইউনিটেও। ২০২২ সালের শুরুর দিকে এই ইউনিট থেকে কাস্টমসের আয় প্রতি মাসে ছয় কোটি টাকার বেশি হলেও ২০২৩ সালে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকায়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফাইজুর রহমানের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে সংযোগ পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জয়েন্ট কমিশনার নাজিউর রহমান বলেন, ব্যাগেজ রুলের আওতায় নিয়মের বাইরে যেসব পণ্য চালান এসেছে সেগুলো খালাস নেওয়া যাবে না।