চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল: ছোট উদ্যোগ থেকে ৮৫০ শয্যার হাসপাতাল
১৯৭৯ সালে ঘোষিত আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের জন্য। কারণ তখন ডায়রিয়া, কলেরা, টিটেনাস, পারটুসিস, যক্ষা, হাম ও পোলিওসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেশি ছিল। ওই বর্ষকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের একটি পরিত্যক্ত সরকারি ভবনে গরিব ও পথশিশুদের চিকিৎসার ছোট একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যা ৪৩ বছরে পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে। কয়েকজন চিকিৎসক, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তার হাত ধরে শুরু হওয়া উদ্যোগটি এখন ৮৫০ শয্যার চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।
বর্তমানে হাসপাতালের বহিঃবিভাগে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ এবং অন্তঃবিভাগে ৬৫০ এর বেশি ভর্তি রোগী চিকিৎসা নেন। ২০২২ সালের বহিঃবিভাগে চার লাখ ৪২ হাজার ১০ জন এবং অন্তঃবিভাগে এক লাখ ৯২ হাজার ৬৭৯ চিকিৎসা নিয়েছিলেন। হাসপাতালটির বাজেটের আকার ১৩৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ৪০০ চিকিৎসকসহ প্রায় দুই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। মূলত প্রায় ১০ হাজার আজীবন সদস্য ও ৪০০ দাতা সদস্য, সরকারি-বেসরকারি অনুদানে চলে বৃহৎ এই হাসপাতালটি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার জন্য আজীবন সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।
হাসপাতালটিতে সাধারণ সব রোগের চিকিৎসাসহ ৩৪ শয্যার সিসিইউ, ৩০ শয্যার অত্যাধুনিক আইসিইউ, কার্ডিয়াক ইউনিট, নিওনেটলজি, শিশু আইসিইউ, নিউরোসার্জারী, মা-শিশুর জন্য বিশেষ ইউনিট, কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার, শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। ক্যাথল্যাবে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। করোনা মহামারিতে বৃহত্তর চট্টগ্রামের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল প্রতিষ্ঠানটি।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নির্বাহী কমিটির সভাপতি অধ্যাপক এমএ তাহের খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "একজন রোগী মাত্র ১০০ টাকায় একজন চিকিৎসক দেখাতে পারেন। এরপর প্রয়োজন অনুসারে রোগীকে অধ্যাপকসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করা হলে কোন ফি দিতে হয় না। তবে সরাসরি অধ্যাপককে দেখাতে চাইলে ৪০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপককে ৩০০ টাকা ও সরকারি অধ্যাপককে দেখাতে চাইলে ২০০ টাকা ফি দিতে হয় একজন রোগীকে। বেসরকারি তবে অলাভজনক উদ্যোগ হওয়ায় স্বল্প খরচে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।"
শুধু চিকিৎসা সেবা নয়, দক্ষ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরিতেও ভূমিকা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ২০০৬ সালে ৫০ আসনের চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে প্রতি ব্যাচে ১১৫ জন শিক্ষার্থী এমবিবিএস সম্পন্ন করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজারেরও বেশি মেডিকেল শিক্ষার্থী ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নার্সিং ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা কোর্সে ৫০ জন এবং ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নার্সিং কলেজের বিএসসি অনার্স (নার্সিং) কোর্সে ৫০ জন ভর্তি করা হয় বছরে। এ পর্যন্ত প্রায় ছয় শতাধিক প্রশিক্ষিত নার্স বের হয়েছে এখান থেকে। চাইল্ড হেলথ ইনস্টিটিউটের অধীনে ডিপ্লোমা কোর্স চালু রয়েছে ১৯৯৭ সাল থেকে। তবে ২০২২ সালে এই ইনস্টিটিউটের অধীনে এমডি (পেডিয়াট্রিক) কোর্স চালু করা হয়েছে।
'৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের কর্মযজ্ঞই বৃহৎ হাসপাতালের ভিত
১৯৭৯ সালের আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ উপলক্ষ্যে সাবেক রাষ্ট্রদূত চট্টগ্রামের মেডিসেন বিশেষজ্ঞ ডা. এএফএম ইউসুফ চমেক হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এএসএম ফজলুল করিম এবং জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার প্রকৌশলী এল কে সিদ্দিকী দরিদ্র ও পথশিশুদের চিকিৎসা সেবা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চমেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক কর্নেল এম মহসিনের সঙ্গে আলাপ করে চূড়ান্ত করলেন। এরপর ডা. এম নুর উন নবী, ফাহমিদা আমিন, এম বি জামান, ডা. রবিউল হোসাইন, ডা. নুরুল আমিন, মোস্তাফা এ হোসাইনকে নিয়ে গঠন করা হলো এডহক কমিটি।
ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের সেন্ট্রাল গভমেন্ট অ্যামপ্লোয়েজি হাসপাতালের পরিত্যক্ত দোতলা ভবনে মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে শুরু হয় চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতাল যাত্রা।
উদ্যোগটির শুরু থেকে সম্পৃক্ত ছিলেন শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আনজুমান আরা ইসলাম। হাসপাতালের নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। হাসপাতালটির পথচলার গল্প বলেন ডা. আনজুমান আরা ইসলা- "আমি তখন চমেক হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার। আমার শিক্ষক ডা. ফজলুল করিম সম্পৃক্ত করেন এই উদ্যোগে। তখন ৭০০ শয্যার চমেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডটি ছিল মাত্র ৪০ শয্যার। তবে অনেক রোগী ছিল।"
১৯৮০ সালের ৫ জানুয়ারি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক এমএ মতিন চট্টগ্রাম শিশু হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। শুরুর দিকে চমেক হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সেবা দিয়েছিলেন। পরে রোগী বাড়তে থাকায় স্থায়ী চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ডা. আনজুমান আরা ইসলাম বলেন, "প্রথমদিকে চমেক হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসক পাঠানো হতো। তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। মাত্র ১০ টাকা রিকশা ভাড়া দেওয়া হতো তাদের। ১৯৮২ সালে ডা. লিয়াকত আলীকে প্রথমবার স্থায়ী চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। হাসপাতালের দোতলায় টিনের ঘর করে ১৯৮৭ সালে ১০ শয্যা থেকে ৩০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময়ের কর্মযজ্ঞ হাসপাতালের কার্যক্রমের গতি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।"
ওই সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনায় তিনি বলেন, "ঘূর্ণিঝড়ের পর ডায়রিয়া রোগী বেড়ে যায়। হাসপাতালের ৩০ শয্যার বিপরীতে ১০০ রোগী ভর্তি ছিল। হিমশিম পরিস্থিতি। মাত্র ছয়টি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে ৩০-৪০ জন শিশুকে একসঙ্গে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। একজনের মুখ থেকে খুলে অন্যজন, তার থেকে খুলে আরেকজনকে— খারাপ অবস্থা ছিল। এই পরিস্থিতির ছবিসহ খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। তখন দেশি-বিদেশি অনুদান আসতে থাকে। সরকারের উচ্চ পর্যায়েও গুরুত্ব পায় হাসপাতালটি। সেবছরই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন। সরকারি প্রায় ৪ দশমিক ২৬৩৭ একর জমি বরাদ্দ পায় হাসপাতাল। এক কোটি টাকা অনুদানও। এরপর দিন দিন হাসপাতালের সেবার পরিসর শুধু বেড়েছে।"
যুক্ত হচ্ছে বড় উদ্যোগ
হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবার পরিসর বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়নও হচ্ছে। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালে ১৩ তলা বিশিষ্ট নতুন হাসপাতাল ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। প্রায় ৭ লাখ বর্গফুটের পুরো ভবনটির কাজ চলতি বছর শেষ হচ্ছে। ১৫০ শয্যার ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ২০২১ সালে। ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই ইনস্টিটিউটটি আগামী বছরের মধ্যভাগে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় প্রায় ১৩০ একর জমির উপর নির্মাণ করা হচ্ছে অটিজম ইনস্টিটিউট এবং বৃদ্ধাশ্রম। এছাড়া ডেন্টাল ইউনিট চালুর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
হাসপাতালের নির্বাহী কমিটির সভাপতি অধ্যাপক এমএ তাহের খান বলেন, "আমরা একটি মেডিকেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছি। যেখানে এক ছাদের নিচে সব চিকিৎসা সেবা থাকবে। আজীবন সদস্যরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে তিন বছরের জন্য নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করেন। তারা স্বেচ্ছাশ্রমে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মানুষের টাকায়, মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি ও অলাভজনক বৃহৎ হাসপাতাল পরিচালনা-একটি মডেল।"