চিফ হিট অফিসার বুশরা কী করবেন?
ছোট থেকেই বুশরা জানতেন, উন্নত কর্মসংস্থান ও শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দেন বাংলাদেশিরা। ঢাকা থেকেও এমন অনেকেই গেছেন বুশরার পরিচিত। বিদেশবিভূঁইয়ে যাতায়াত সম্পর্কে জানাশোনা তার নতুন নয়।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা-ই বুশরার নিজের শহর। দিনে দিনে এ শহরের তাপদাহ এত বাড়ছে, যে সম্পন্নরা সুযোগ থাকায় পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে।
বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে। সম্প্রতি তাকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান – অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আর্শট-রকফেলার) বাংলাদেশ তথা এশিয়ার প্রথম 'চিফ হিট অফিসার' (সিএইচও) পদে নিয়োগ দিয়েছে।
নিয়োগ পাওয়ার আগে গেল সপ্তাহে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট'কে বুশরা বলেছিলেন, 'ঢাকা আমারই প্রাণের শহর, কিন্তু আজকাল এই শহর যেন বদলে গেছে, দিনে দিনে আরো অসহনীয় হয়ে উঠছে গরম'। ঢাকা সম্পর্কে 'বসবাসের অযোগ্য' এই উক্তিই আজকাল বেশি শোনা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মাসিক গড় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কিন্তু, এই অঞ্চলে উচ্চ আদ্রতার কারণে তা আরো বেশি মনে হয় গরমকালে। জলবায়ু পরিবর্তন এই পরিস্থিতিকে আরো চরম করে তুলছে।
গত মাসে এক দাবদাহের সময় ঢাকায় ৪০.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা ছিল ছয় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে বলছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধি ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশকে আরো উষ্ণ করে তুলবে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ক্রমেই স্থায়ী এক তাপপ্রবাহের অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে'।
এই সংকট মোকাবিলার জন্যই গতকাল বুধবার বুশরা আফরিনকে বাংলাদেশ তথা এশিয়ায় তাদের প্রথম সিএইচও হিসেবে নিয়োগ দেয় আর্শট-রকফেলার। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী এপর্যন্ত যাদের চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে তারা সকলেই হলেন নারী।
এরা হলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহরের জন্য জেন গিলবার্ট, চিলির সান্তিয়াগোর জন্য ক্রিস্টিনা হুইদব্রো, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে ইউজিনা কার্গবো, গ্রীসের এথেন্সে এলিজাবেথ বার্জিয়ানি, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ক্রিস্তিয়া মিলনে ও টিফানি ক্রফোর্ড এবং বৈশ্বিক প্রধান হচ্ছেন এলেনি মায়রিভিলি।
ঢাকায় বুশরার কাজ কী হবে?
বুশরা আফরিন সমাজের সর্বস্তরের সাথে এবং বিশেষত তাপদাহে চরম ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ঢাকায় চরম তাপমাত্রা প্রশমনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ শনাক্ত করার পাশাপাশি- সেগুলোর সমাধান খুঁজবেন।
তার প্রধান দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে, চরম তাপমাত্রার উচ্চ ঝুঁকি সম্পর্কে জন-সচেতনতা সৃষ্টি; ঝুঁকিগ্রস্ত সম্প্রদায় ও এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করা; অংশীজনের সাথে কার্যক্রমের সমন্বয় স্থাপন; উচ্চ তাপের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি হ্রাস এবং নগরকে শীতল রাখার প্রকল্প বাস্তবায়ন।
বুশরা বলেন, 'চরম তাপপ্রবাহের অদৃশ্য ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশই এবিষয়ে নাগরিকদের আগাম সতর্ক করে। তাপপ্রবাহের সময় বাইরে বের হলে কী করতে হবে- সে সম্পর্কে পরামর্শ দেয়। কিন্তু, বাংলাদেশে সে ব্যবস্থা নেই'।
'চরম তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এজন্য তাদের নীতি-প্রণয়নে সম্পৃক্ত করা দরকার'- যোগ করেন তিনি।
বুশরা বলেন, তাপপ্রবাহে দুর্ভোগে থাকা সাধারণ মানুষের মতামত নীতি প্রণয়নের সময় শোনা হয় না। তাদের কথা, বিশেষত নারীরা যারা সবচেয়ে বেশি বেশি দুর্ভোগ পোহান তাদের কথাও শুনতে হবে।
তিনি জানান, বিশ্বের অন্যান্য শহরে নিয়োজিত চিফ হিট অফিসাররা ভবন, ফুটপাথ, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তারা গাছ লাগানোর মতো বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেন।
'ঢাকায় জায়গার খুব স্বল্পতা থাকায় এখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কীভাবে খুদে বন গড়ে তোলা যায় আমাদের তার উপায় সন্ধান করতে হবে। চরম হিটস্টোক এড়ানোর অনেক উপায় আছে। সঠিক উপায় খুঁজে বের করে, স্থানীয় বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কী করা দরকার এবং কীভাবে তা করা যায়– সেজন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হবে।
ঢাকায় তীব্র তাপপ্রবাহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসির) সঙ্গে অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের (আর্শট-রকফেলার) মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। এর আওতায় ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে ডিএনসিসি ও আর্শট-রকফেলার যৌথভাবে কাজ করবে।
এই উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে বুধবার (৩ মে) এক অনুষ্ঠানে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে তাপমাত্রা কমাতে আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন আমাদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছে… আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা ঢাকা শহরে দুই লাখ গাছ লাগাব'।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বুশরাকে নিয়োগের সাথে ডিএনসিসির কোনোপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক বা আর্থিক সম্পৃক্ততা নেই। যথাযথভাবে যোগ্যতা যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেবল ফাউন্ডেশনটি তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে'।
তিনি আরো বলেন, এ নিয়োগটি সত্যিই আমাদের দেশের জন্য অনেক বেশি গর্বের এবং আনন্দের। বুশরা আফরিন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশবাসীকে গর্বিত করবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বুশরা আফরিন কে?
ঢাকার একটি স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার পর কানাডায় উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন বুশরা আফরিন। এরপর কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতক করেন। ঘানার ইনস্টিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্ট স্টাডিজেও পড়াশোনা করেছেন।
একজন সমাজকল্যাণ নির্বাহী হিসেবে বুশরা আফরিন বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি টেকসই পণ্য সরবরাহের অগ্রগতির বিষয়ে কাজ করেছেন।
তার নেওয়া অন্যতম একটি উদ্যোগ ছিল পোশাক কারখানায় তাপমাত্রা হ্রাসে টাস্কফোর্স গঠন। এছাড়া, কারখানার পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার মাধ্যমে কর্মজীবী মায়েদের সন্তানকে স্তন্যদানের পৃথক কক্ষের ব্যবস্থা করা এবং ডে-কেয়ার সেন্টারে শিশুদের দেখভালকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন।
এছাড়া 'প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯' এর নীতিগত পরিবর্তন ও বাস্তবায়ন নিয়ে তিনি একজন পলিসি অ্যাডভোকেসি কনসালটেন্ট হিসেবে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।
নীতি-পরামর্শক হিসেবে কাজ করার আগে তিনি একজন ব্যবস্থাপনা নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন। ওই পদে থাকার সময় তিনি চলমান বিভিন্ন ক্ষুদ্র-ঋণ উদ্যোগের প্রভাব ও কার্যকারিতা মনিটর করেছেন।
বাংলাদেশে সামাজিকভাবে সৃজনশীল ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর জন্য তহবিল ও বৈশ্বিক স্বীকৃতি আনতে তিনি ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (সিডিএফ) এবং সিটিব্যাংক এনএ-র সহযোগিতায় সিটি মাইক্রো-এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ডস (সিএমএ) আয়োজনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন।
বিশ্বব্যাপী সিএইচওদের কর্মকাণ্ড
আর্শট-রকফেলার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি বিশেষত তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন শহরে চিফ হিট অফিসার (সিএইচও) নিয়োগ দিয়ে থাকে। সর্বপ্রথম ২০২১ সালে তারা সিএইচও নিয়োগ দেয়।
তাদের প্রধান লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে মানুষের চরম তাপপ্রবাহ মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানো।
চিলির সান্তিয়াগোর শহরের সিএইচও ক্রিস্টিনা হুইদব্রো। আর্শট-রকফেলারের ওয়েবসাইট অনুসারে, সান্তিয়াগোর মেয়র নগরীর তাপমাত্রা কমাতে ২০ লাখ বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে এক শহুরে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহরের জন্য বিশ্বের সর্বপ্রথম সিএইচও হিসেবে নিয়োগ পান জেন গিলবার্ট। মে-অক্টোবর সময়কে আনুষ্ঠানিক তাপদাহের মৌসুম হিসেবে শনাক্ত করতে তিনি নগর প্রশাসনের সাথে কাজ করেছেন।
ফ্লোরিডায় বহুভাষী সম্প্রদায়ের আবাস রয়েছে, তাদের কারো কারো মধ্যে খুবই জনপ্রিয় রেডিও সম্প্রচার। সেখানে সরকারি বিভিন্ন পরিষেবার ঘোষণা দেওয়া হয়।
জেন গিলবার্ট ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি বিষয়ক একটি জনসচেতনতামূলক রেডিও কর্মসূচিকে ব্যবহার করেন উচ্চ তাপের ঝুঁকি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে।
গত বছর গিলবার্ট একটি গণমাধ্যমকে জানান, শহরের যেসব এলাকায় তাপদাহ সংক্রান্ত অসুস্থতা বেশি সেসব এলাকায় বিলবোর্ড স্থাপন ও বাসস্টপে সচেতনতামূলক পোস্টারও লাগানো হয়েছে।
ফ্রিটাউনের সিএইচও ইউজিনা কার্গবো ব্যবসায়ীদের থেকে জানতে পারেন, প্রচণ্ড তাপ থেকে রক্ষা পেতে দোকানের জন্য আচ্ছাদন তাদের সবচেয়ে বেশি দরকার। খুবই সহজ এই সমাধান তাদেরকে প্রচণ্ড তাপের হাত থেকে যেমন বাঁচায়, তেমনি তাদের জীবিকানির্বাহের উপায়- দোকানের পণ্যকেও সুরক্ষিত রাখে।
সিএইচও'দের যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়?
আর্শট-রকফেলারের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, যেসব দেশের সরকার তাপপ্রবাহ মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, তাদের স্থানীয় কর্মকর্তারাও চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
মেয়র ও স্থানীয় নেতারা যখন সিএইচও পদ তৈরি করে চরম তাপদাহ মোকাবিলায় যথাযথ সম্পদ নিয়োজিত করেন, তখন তারা আসলে জলবায়ু পরিবর্তন-সহনশীল এক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য বিনিয়োগ করেন। এতে জীবন ও জীবিকার ক্ষয়ক্ষতিও হ্রাস করা যায়।
বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশে একজন করে সিএইচও নিয়োগের পরিকল্পনা আছে আর্শট-রকফেলারের।