ভাতের উপর চাপ কমেছে, মাছ-মাংস বেশি খাওয়া হচ্ছে: প্রতিবেদন
বাঙালির ভাত বেশি খাওয়ার যে বদনাম, তা কিছুটা কমতে শুরু করলো বুঝি! কারণ বাঙালি ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। আবার ভাত খাওয়া কমিয়ে মাছ-মাংস, দুধ বেশি করে খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ সব তথ্য উঠে এসেছে। বিবিএসের প্রতিবেদনে মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে চাল, গম, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য এবং ফলমূল ভোগের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে।
২০১৬ সালের তুলনায় ভাত ও গমের ব্যবহার কমলেও প্রধান খাবারগুলোর মাথাপিছু গড় কনজাম্পশন ৭৩৪.৭ গ্রাম থেকে বেড়ে ৮২০.৮ গ্রামে পৌঁছেছে।
এই সার্ভেতে বলা হয়, ২০১৬ সালে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৩৬৭.২ গ্রাম চালের ভাত খেত। এখন সেটা ৩৮.৩ গ্রাম কমে ২২৮.৯ গ্রামে নেমে এসেছে। অন্যদিকে মাছ, মাংস, সবজি খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে মানুষ। তবে একটু ব্যতিক্রম হলেও দেখা গেছে, ডিমের কনজাম্পশন কমে গেছে।
পুষ্টিবিদ, কৃষি ও অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের এই অভ্যাস পরিবর্তনের পেছনে কয়েকটি ব্যাপার কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে উৎপাদন, খাদ্যের প্রাপ্যতা, প্রাইস লেভেল ও আয় খাদ্যাভ্যাস প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দরিদ্র মানুষের আয় এক শতাংশ বাড়লে ভাত বা গমের চাহিদা ০.৩ শতাংশের কম বাড়লেও ফলমূল, দুধ ও সবজির চাহিদা দেড় শতাংশ হারে বাড়ে। কাজেই পুষ্টিকর খাবার বৃদ্ধির এই প্রবণতা মানুষের আয় বৃদ্ধির একটি নির্দেশক।
তিনি আরও বলেন, গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ, মাংস, ফল ও সবজির উৎপাদন বছরে ৫ শতাংশের বেশি হারে বাড়ছে। পুষ্টিকর খাবারের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় ভাতের চাহিদা কমছে বলেও তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির মহাসচিব অধ্যাপক ড. মিজানুল হক খান বলেন, আয় একেবারেই কম থাকলে ভাতের চাহিদা পূরণ করতেই আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায়। আয় যত বাড়ে, পুষ্টিকর খাবারের চাহিদাও তত বাড়ে।
খাদ্যাভ্যাসে এই পরিবর্তনের পেছনে উৎপাদন, আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিও একটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।
ল্যাব-এইড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ সামিয়া তাসনিম বলেন, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের প্রবণতা গড়ে বাড়ছে বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। এই বৃদ্ধির সুফল যদি দরিদ্রদের দিকেও যায়, তা হলে এটা ইতিবাচক বিষয়।
তিনি বলেন, ভাতের ব্যবহার কমলে মানুষ পুষ্টিকর খাবার বেশি গ্রহণ করে। এর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সুবাদে মানব সম্পদের উন্নতি নিশ্চিত হয়। ভবিষ্যতে শিক্ষা, দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধিতেও বিষয়টি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সার্ভেতে উঠে এসেছে, ২০২২ সালে মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দিলেও অল্প পরিমাণে গমের কনজাম্পশন বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এই তুলনাটা করা হয়েছে ২০১৬ সালের সঙ্গে। ছয় বছর আগে গমের কনজাম্পশন ছিল ১৯.৮ গ্রাম, যেটা বর্তমানে ২২.৯ গ্রামে উন্নীত হয়েছে।
টিসিবির বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, ডলার সংকট ও আমদানির উৎস সংকোচনের কারণে দেশে অন্যান্য বছরের তুলনায় গমের আমদানি অর্ধেকে নেমে আসে। এ কারণে গম থেকে তৈরি আটা, ময়দা এবং এর তৈরি বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ কারণে বাধ্য হয়েই মানুষ এর কনজাম্পশন কমিয়ে দেয়।
তবে বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয় বছর আগে গমের বাজারটা এত বড় ছিল না, আমদানিও ছিল কম। স্থানীয় উৎপাদনের (১০-১২ লাখ টন) উপরই বেশিরভাগ মানুষ নির্ভর করতো। কিন্তু এখন এই উৎপাদনের সঙ্গে আমদানির ৪০ লাখ টন যোগ করলেও সরবরাহ অনেক বেশি এবং ছয় বছরের তুলনায় গম ও গম দিয়ে তৈরি খাদ্যপণ্যের ব্যবহার বা ভোগ বেশি বেড়েছে। এসবের সঙ্গে মানুষের অভ্যস্ততাও বেড়েছে।
বিবিএস বলছে, প্রতিনিয়তই মানুষের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে সেটা কোয়ালিটি খাদ্যপণ্যের ভোগের মাধ্যমেই গ্রহণ করছে মানুষ। আবার ছয় বছর আগের তুলনায়, মাছ, মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়েছে। এই সহজপ্রাপ্যতার কারণে মানুষও এসব খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, আগের চেয়ে বেশি মাছ-মাংস খাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটা সময় ছিল যখন চৈত্র-বৈশাখে নদ-নদী, খাল, বিল, পুকুরের পানি শুকিয়ে যেত, খুব একটা মাছ পাওয়া যেত না। এখন কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে। সারাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষের মাছ এই সরবরাহ ঘাটতি দূর করেছে। একই সঙ্গে মানুষের আয় বেড়ে যাবার কারণে মাছ খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে চলতি বছরে বিভিন্ন ধরনের সস্তা মাছও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। যে কারণে কিছুটা ভোগ্য কমছে বলে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে মাছের মাথাপিছু গড় কনজাম্পশন ছিল ৬২.৬ গ্রাম, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭.৮ গ্রামে। মাছের পাশাপাশি বেড়েছে সবজি খাওয়ার পরিমাণ। হাইব্রিড এসে সবজির উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে সরবরাহ অনেক বেড়েছে। যদিও শীত ছাড়া বছরের অন্য সময়ে সবজির দাম চড়াই থাকে।
একইভাবে গরুর মাংসের দাম কম থাকলেও মুরগির মাংসের দাম একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সারাবছরই থাকছে। যে কারণে সারাদেশের মানুষের মধ্যেই মুরগির মাংস একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হয়ে উঠেছে। কখনো কখনো বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলেও সেটা হয় সীমিত সময়ের জন্য। বাকি সময়ে সরবরাহ ও দাম দুটোই থাকে ভোক্তার নাগালে। যে কারণে বেড়েছে মাংসের কনজাম্পশন।
বিবিএস বলছে, ছয় বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু মাংসের কনজাম্পশন ২৫.৪ গ্রাম থেকে ৪০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। একইভাবে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের কনজাম্পশন ২৭.৩ গ্রাম থেকে বেড়ে ৩৪.১ গ্রামে উন্নীত হয়েছে।
মাছ-মাংসের কনজাম্পশন বাড়লেও শুধু ডিমের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। মানুষ গড়ে ডিম খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন একেকজন মানুষ গড়ে ১৩.৬ গ্রাম থেকে কমিয়ে ১২.৭ গ্রাম করে ডিম খাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর দুয়েক ধরেই ডিমের সরবরাহ ভালো থাকলেও দাম বেশি। অন্যদিকে যখন মানুষ মাছ-মাংস বেশি খাবে তখন ডিমের উপর কিছুটা চাপও কম থাকবে।
এদিকে মানুষের প্রধান খাদ্য তালিকায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে ফলের কনজাম্পশনের ক্ষেত্রে। মানুষ নিয়মিত ফল খাওয়া শুরু করেছে তার একটা প্রমাণ মেলে বিবিএসের তথ্যে। ছয় বছর আগে মাথাপিছু ৩৫.৮ গ্রাম ফল খাওয়ার অভ্যেস ছিল। যেটা ছয় বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৯৫.৪ গ্রামে উন্নীত হয়েছে।
ফল উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর থেকে ফলে আমদানি কিছুটা কম হলেও দেশে ফলের উৎপাদন প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এর মধ্যে পেয়ারা, আম, লিচু, তরমুজ, আনারস, বরই, কলা সহ বিভিন্ন ফলে সারা বছরই ভোক্তারা মেতে থাকে। বর্তমানে দেশেই ফলের উৎপাদন এখন ১.৪০ লাখ টনে পৌঁছেছে।
বিবিএস বলছে, মানুষের ক্যালরি ইনটেকের পরিমাণ ছয় বছরে বেড়েছে। জাতীয়ভাবে ক্যালরি ইনটেকের পরিমাণ ৮.২৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৩৯৩ কিলো কিলোরিতে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বিবিএস বলছে, খাবারের পিছনে মানুষ খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।
পরিবারগুলোর পরিবারপ্রতি খাবার বাবদ ব্যয় ৭,৩৫৪ টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে।