শুল্ক ছাড়ের প্রভাব নেই বাজারে, বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী
অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণ করতে নিত্য প্রয়োজনীয় ছয় পণ্যের শুল্ক-কর ছাড় দিয়েছে সরকার। কিন্তু শুল্ক ছাড়ের দেড় মাস পার হলেও আমদানি তেমন একটা বাড়েনি। ফলে দু-একটি পণ্যের দাম কিছুটা কমলেও বেশিরভাগ পণ্যের দাম এখনো চড়া।
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেওয়া ও শুল্ক–কর কমানোর একটি সুফল হলো, বাজার স্থিতিশীল হয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, আমদানিকারকেরা মুনাফা না হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আমদানি করেন না।
তিনি বলেন, "বাজারে আমদানিকারক যখন গুটিকয়েক হন, তখন আমদানি ও দাম তাদের মর্জির ওপর নির্ভর করে। তাই বাজারে সরবরাহকারী বৃদ্ধির জন্য আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সচেতনতা জরুরি।"
চাল
চাল আমদানি বৃদ্ধি করতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে সরকার।
কিন্তু সরকার প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও আমদানি হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টন চাল।
এতে গত এক মাসে বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে দুই টাকা কমলেও মাঝারি ও সরু চালের দাম তিন থেকে চার টাকা বেড়েছে।
বর্তমানে খুচরা পর্য়ায়ে প্রতিকেজি পাইজাম ও মিনিকেট ৭০ টাকা, বেথি ৬৫ টাকা, কাটারিভোগ ৮৫ টাকা, আটাইশ ৬২-৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম চাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, "চাল আমদানি কম হওয়ার কারণ, রপ্তানিকারক দেশে দাম বেশি এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ফলে শুল্ক কমিয়েও চাল আমদানি লাভজনক হচ্ছে না।"
চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আফসানা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী ওমর আজম বলেন, আমদানিতে প্রতিকেজি ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৫৫ টাকার মতো। কিন্তু বাজারে মোটা চালের দাম ৫২ থেকে ৫৩ টাকা। আমদানি করলে বাজারে দাম পাওয়া যাবে কি-না, সে চিন্তায় আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, "আমদানির সুযোগ করে দেওয়ায় চালের বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে না। তবে আমদানির অনুমতির সময়সীমা বাড়াতে হবে।"
ভোজ্যতেল
ভোজ্যতেল আমদানিতে দুই দফায় শুল্ক–কর কমানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক–কর কমিয়ে তা নামানো হয়েছে শুধু ৫ শতাংশে।
তাতে প্রতিকেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ক–কর ১৭-১৮ টাকা থেকে কমে ৭ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ, প্রতিকেজি শুল্ক–কর কমেছে ১০-১১ টাকা।
এনবিআরের তথ্যমতে, চলতি মাসে গত শনিবার পর্যন্ত ২৩ দিনে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যাংক টার্মিনাল থেকে মোট ৬৫ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেল খালাস করেছেন ব্যবসায়ীরা।
আরও ৪৫ হাজার টন তেল নিয়ে চারটি জাহাজ এসেছে। সাধারণত প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা পৌনে দুই লাখ টন।
তবে বাজারে বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৭ টাকা— যা গত দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১৫৬ টাকায়। পাশাপাশি প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা— যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৪৬ টাকা। আর পাম তেল সুপার প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৫৮ টাকায়— যা আগে ১৫১ টাকা ছিল।
ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, "বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি। তবে শুল্ক–কর কমানোর কারণে এই বাড়তি দাম সমন্বয় হয়ে গেছে। যদি শুল্ক–কর না কমানো হতো, তাহলে লিটারপ্রতি ১৩-১৪ টাকা দাম বাড়ত।"
এতদিন অনিশ্চয়তার কারণে আমদানি কম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এখন শুল্ক–কর কমানোর কারণে সামনে সরবরাহ বাড়বে।"
চিনি
চিনি আমদানিতেও শুল্ক–কর কমিয়েছে সরকার। আগে প্রতিকেজি অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩৮-৪০ টাকা শুল্ক–কর দিতে হতো। এখন দিতে হচ্ছে, প্রতিকেজি ২৩ টাকা। অর্থাৎ, প্রতিকেজি শুল্ক–কর কমেছে প্রায় ১৫-১৭ টাকা।
শুল্ক–কর কমানোর পর গত মাসের ১৭ অক্টোবরের পর ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার টন। এরমধ্যে বাজারজাত হয়েছে ৫০ হাজার টন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনি আমদানি পরিস্থিতি সন্তোষজনক।
তবে বাজারের চিত্র উল্টো। বর্তমানে প্রতিকেজি প্যাকেটজাত চিনি ১৪০ টাকা ও খোলা চিনি ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে— যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৩০-১৩৫ টাকা।
পেঁয়াজ
পেঁয়াজ আমদানি বাড়াতে গত সেপ্টেম্বরে ও নভেম্বরে দুই দফায় শুল্ক–কর কমায় সরকার। এতে গত এক মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৭৭ হাজার টনের কিছু বেশি। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৬১ হাজার টন।
শুল্ক কমায় আমদানি কিছুটা বাড়লেও ১০০ টাকার নিচে নামেনি আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম। বর্তমানে বাজারে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ১২০ টাকা, পাকিস্তানি পেঁয়াজ ১০৫ টাকা ও মিশরের পেঁয়াজ ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলয় কুমার পোদ্দার জানান, "পেঁয়াজের চাহিদার অন্তত ৩০ শতাংশ পূরণ করা হয় আমদানি করে। ফলে বছরের শেষ দিকে আমদানি বাড়ে। কারণ, তখন দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যায়।"
বর্তমানে শুল্ক কমলেও ভারতীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। তাই শুল্ক কমিয়েও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে, গুণগত কারণে বাজারে দেশীয় ও ভারতীয় পেঁয়াজের চাহিদা বেশি। তাই বিকল্প দেশ হিসেবে পাকিস্তান ও মিশর থেকে পেঁয়াজ আসলেও সেসব পেঁয়াজের চাহিদা কম থাকায় বাজারে প্রভাব পড়ছে না।
আলু
বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ৫ সেপ্টেম্বর আলু আমদানিতে শুল্ক–কর ছাড় দেয় সরকার। দেশে প্রতিমাসে ৮ লাখ টনের বেশি আলুর চাহিদা থাকলেও শুল্ক ছাড়ের পর এখন পর্যন্ত আলু আমদানি হয়েছে মাত্র ৪০ হাজার টন। ফলে আমদানি করা সামান্য আলু বাজারে বড় প্রভাব ফেলছে না।
টিসিবির হিসাবে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রতিকেজি আলুর দাম ১০ টাকা বেড়েছে। এখন প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা দরে।
ইতোমধ্যে বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু করলেও তার প্রভাব পড়েনি দামে। নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৫০ টাকা কেজিতে।
ডিম
বন্যায় খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বাজারে প্রতি ডজন ডিমের দাম ঠেকে ১৮০-১৮৫ টাকায়। এরপর গত ১৭ অক্টোবর ডিম আমদানিতে শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এরপর এখন পর্যন্ত ৫৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পান ব্যবসায়ীরা।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর তথ্যে, এখন পর্যন্ত ডিম আমদানি হয়েছে মাত্র ১০ লাখ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর দাম কিছুটা কমে প্রতি ডজন ডিম ১৪৫ টাকায় পৌঁছে। তবে আশানুরূপ আমদানি না হওয়ায় তা ধীরে ধীরে বেড়ে এখন আবার ১৫০-১৫৫ টাকায় ঠেকেছে।
আগামী মার্চে পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। তাই শুল্ক–কর কমানোর পাশাপাশি রোজার পণ্যের আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকও ঋণপত্রের শর্ত শিথিল করেছে।
এদিকে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনই আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে রোজায় সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকতে পারে।