মেয়রের ব্যবসা, তাই গাছ কেটে সাবাড়!
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পৌরসভায় পৌর ভবনের সামনে বিশাল একটা অর্জুন গাছ। যত দ্রুত সম্ভব বিশাল এই গাছটিকে কাটার জন্য চলছে তোড়জোর। কিছুক্ষণের মধ্যে গাছটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো। গাছকাটার শ্রমিকরা জানেন না কে এসব গাছের মালিক। তারা দেখিয়ে দিলেন এক ব্যক্তিকে। তিনি গাছ কাটার ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই দ্রুত পালিয়ে গেলেন তিনি।
পরে স্থানীয় পৌরসভা, বনবিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগে (সওজ) খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গাছ কাটছেন পৌর মেয়র মো. জুয়েল আহমদ। জায়গাটি সওজের। মেয়র বনবিভাগের কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে এই গাছ কাটার অনুমতি নিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি ১২৯টি গাছ কেটে ফেলছেন, যার মধ্যে ১২৮টি অর্জুন গাছ। যদিও গাছ কাটার কারণ নিয়ে একটি অফিসের তথ্যের সাথে মিল নেই আরেকটি অফিসের এবং গাছ কাটার কারণ নিয়েও রয়েছে লুকোচুরি।
সওজ বলছে, তাদের কোনো প্রকল্প নেই বা রাস্তা বড় করার মতো কোন কাজও নেই। তাই তাদের প্রয়োজনে গাছ কাটা হয়নি।
মেয়র এখন বিদেশ ভ্রমণে আছেন । তবে ভারপ্রাপ্ত পৌর মেয়র আনসার শুকুর মান্না জানালেন, জনগণের সুবিধার জন্য কাটা হচ্ছে। যদিও কী সুবিধা, তা তিনি বলতে পারেননি।
এদিকে বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম মেনে সামাজিক বনের গাছ কাটার সময় হয়েছে; তাই মেয়র জুয়েল নিলামে অংশ নিয়ে এই গাছ কাটার অনুমোদন পেয়েছেন। তবে আরেক কর্মকর্তা বলেন, পৌরসভার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা অল্প কিছু গাছ কাটার অনুমোদন দিয়েছেন।
তবে এ কাজে স্থানীয় মেয়র জড়িত। আর গাছ বিক্রি করে তিনি যে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন, তা উঠে এসেছে সবার দেওয়া তথ্যে।
বন বিভাগের সহকারী বনসংরক্ষক মারুফ মিয়া জানান, এই গাছগুলো বনবিভাগ লাগিয়েছিল সওজের জায়গাতে এবং এসব গাছ রক্ষনাবেক্ষণের জন্য যারা উপকারভোগী ছিলেন তারা এই গাছের মূল্য পাবেন। গাছগুলো বিক্রির নিলাম হয় সিলেট বন বিভাগের অফিস থেকে। সেখানে পৌর মেয়র জুয়েল অংশ নেন এবং তিনি গাছগুলো কিনে নেন। এখানে আবার বনায়ন করা হবে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তৌফিক আহমদ বলেন, কমলগঞ্জ পৌরসভা কয়েকটি গাছ কাটার অনুমতি চাইলে তারা অনুমতি দিয়েছেন।
তবে নিজের লাভের কারণে পৌরসভার বড় বড় গাছ কেটে সৌন্দর্য নষ্ট করাকে মেয়র পৌরবাসীর চেয়ে নিজের আর্থিক লাভকেই বড় করে দেখছেন বলে মনে করছেন পৌরসভার সচেতন নাগরিকদের একপক্ষ। যদিও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। বিভিন্ন অফিসের তথ্যেও রয়েছে গরমিল।
সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমলগঞ্জ পৌরসভার ভানুগাছ পয়েন্ট থেকে পৌর ভবনের সামনে দিয়ে লাউয়াছড়া হয়ে শ্রীমঙ্গল যে সড়কটি গেছে সেটি সওজের অধীনে। এই জায়গায় বৃক্ষরোপণ করে বন বিভাগ। হঠাৎ করেই রাস্তার দুপাশে থাকা ১২৯ টি গাছ কাটা শুরু হয় যার মধ্যে ১২৮টি গাছ ছিল অর্জুন এবং একটি রেইন ট্রি।
রাস্তার দুপাশে পড়ে আছে কাটা গাছ। ট্রাকে তুলে শ্রমিকরা নিয়ে যাচ্ছেন। গাছ কাটার দায়িত্ব থাকা ম্যানেজার সাংবাদিক পরিচয় পেলে পালিয়ে যান। পরে পৌর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গাছ কাটার বিষয় নিয়ে আলাপ চলাকালে ১ ঘণ্টা পর তিনি ফিরে আসেন এবং অনুমোদনের একটি কপি দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। পরে সেই অনুমোদনের কাগজ খুলে দেখা যায় সেটি অন্য একটি জায়গার অনুমোদনের কাগজ। যদিও এখানেও অনুমোদন রয়েছে মেয়রের নামে কামাছড়া বিটে।
ভারপ্রাপ্ত মেয়র আনসার শুকুর মান্না জানান, 'কার নামে গাছের নিলাম হয়েছে, বলতে পারছি না। তবে গাছগুলো জনগণের সেবার প্রয়োজনে কাটা হচ্ছে। এদিক দিয়ে পানির লাইন যাবে।'
অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, আরও ২০০ গাছ কাটা হবে, যা পৌরসভার পরের ব্রিজ থেকে লাউয়াছড়া অভিমুখী রাস্তার দিকে এখন দাঁড়িয়ে আছে।
পরিবেশবাদীরা বিষয়টি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন। কমলগঞ্জ জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সভাপতি মনজুর আহমদ আজাদ মান্না বলেন, 'অর্জুন গাছের বাতাস খুবই উপকারী। এছাড়া এর প্রতিটি অংশই ঔষধিগুণ সম্পন্ন।'
তিনি আরও বলেন, 'শুনলাম পৌরসভার ড্রেনেজ ব্যবস্থার জন্য বন বিভাগ গাছগুলো কাটার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু গাছগুলো না কেটে ড্রেনেজের জন্য পৌরসভা যদি আধুনিক কোনো প্রকল্প গ্রহণ করত, তাহলে সেটা প্রশংসনীয় হতো।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, 'যেখানে পৌর মেয়র নিজেই গাছ ব্যবসায়ী এবং তিনি এই গাছকাটার নিলাম নিয়েছেন, যেখানে তিনি গাছ কাটবেন লাভ করবেন, সেখানে আর কার কাছে কী আশা করতে পারেন?'