প্রজননের ভর মৌসুমে মিলছে না ডিম, হালদা পাড়ে বৃষ্টির অপেক্ষা…
চলছে কার্প-জাতীয় মাছের ভরা প্রজনন মৌসুম। হালদা পাড়ের জেলেরা অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন গত ২০ দিন ধরে। কিন্তু, চলতি মাসে দুটি 'জো' (ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়) গত হতে চললেও ডিমের দেখা নেই; এমনকি নমুনা ডিমও দেয়নি মা মাছ। গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা ও বজ্রসহ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হালদায় ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে মা মাছদের ডিম ছাড়ার অপেক্ষার দিন ক্রমে বেড়েই চলেছে।
প্রতি বছরের চৈত্র থেকে আষাঢ়ে বজ্রসহ ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নামে হালদা নদীতে। এসময় পাহাড়ি ঢলের ফলে হালদা নদীর বাঁকগুলোতে পানি ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনাকারে প্রবাহিত হয়। তখন নদীর বাঁকে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হলে ও তাপমাত্রা অনুকূলে ২৫-২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলে ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরুর পর থেকে হালদা পাড়ের কয়েক'শ জেলে তাদের নৌকা ও সরঞ্জামাদি নিয়ে হালদায় ডিম সংগ্রহের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। ডিম সংগ্রহের পর রেণু ফোটানোর জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে হ্যাচারিগুলোও। কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে মা মাছের প্রজননের সময়। কমছে বৃষ্টিপাত, বাড়ছে তাপমাত্রা। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে হালদা নদীতে বাড়ছে লবণাক্ততাও।
হালদা ডিম সংগ্রহকারী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শফি বলেন, 'মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সমিতির কয়েক শ' সদস্য তাদের নৌকাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে হালদায় ডিম সংগ্রহের অপেক্ষা করছেন। অনেকে দাদন নিয়ে জাল ও নৌকা কিনেছেন। কিন্তু, সঠিক সময়ে ডিম না পেলে জেলেরা সব হারাবে। বিশেষ করে ডিম ছাড়ার সময় লবণ পানি চলে আসায়- গত দুই বছর ডিম নষ্ট হয়ে জেলেরা লোকসান গুনেছে।'
হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলামের গবেষণায় দেখা গেছে, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে হালদা নদীতে পানির গড় তাপমাত্রা ছিলো ৩২ দশমিক ৪ থেকে ৩৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পানির গড় তাপমাত্রা ছিলে ৩৪ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অর্থাৎ, একমাসের ব্যবধানে পানির তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের জন্য পানির আদর্শ তাপমাত্রা হলো ২০-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
অপরদিকে, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ০ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৫ পিপিটি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পানিতে লবণাক্ততার পরিমান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ পিপিটি পর্যন্ত। হালদায় একমাসের ব্যবধানে পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে দশমিক ৫ পিপিটি।
এছাড়া এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে হালদা নদীতে পানির ইলেকট্রিক্যাল কনডাক্টিভিটি ৩৭৯ থেকে ৩০১৩ মাইক্রোসিমেন্স এবং মে মাসের প্রথম সপ্তাহে যা বেড়ে ৬২০ থেকে ৪০০০ মাইক্রোসিমেন্সে দাঁড়িয়েছে। মাছের প্রজননের জন্য যার আদর্শ মান হলো ৩৫০ মাইক্রোসিমেন্স।
তরুণ গবেষক শফিকুল ইসলাম বলছেন, "মেজর কার্প-জাতীয় মাছের প্রজনন আচরণ পানির তাপমাত্রার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা মা মাছের প্রজননের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সে জন্য হালাদায় কার্প-জাতীয় মাছের প্রজনন চক্রের সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং হ্রাস পাচ্ছে প্রজনন ক্ষমতা। লবনাক্ততা ও অতি তাপমাত্রার কারণে মা মাছের হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে, যার ফলে হালদায় ক্রমাগত ডিম উৎপাদন কমে যাচ্ছে।"
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইতোমধ্যে একটি বা দুটি জো চলে গেছে, বর্তমানেও একটি জো চলছে। কিন্তু, পানির উষ্ণতা বেশি থাকার কারণে নদীতে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে মা মাছ ডিম ছাড়ছে না।'
হালদা নদীর দুই তীরে রিটার্নিং ওয়াল তৈরি ও ব্লক ফেলার কারণে নদীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে নদীর পানির তাপমাত্রা আরও বেশি বাড়ছে বলে দাবি করেন অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি বলেন, "নদীর নিজস্ব জীবন সত্ত্বা রয়েছে। দেশের উচ্চ আদালতও তাই বলছে। অথচ আমরা নদীটির দুই তীরে বল্ক ফেলে ও সিমেন্টের দেওয়াল তৈরি করে এর স্বাভাবিক চলাকে বাধাগ্রস্ত করেছি। এছাড়া তীরে ফেলা ব্লকগুলো নদীর তলদেশে গিয়ে তা সলিড করে ফেলছে। ফলে মাটি তাপ শোষণ করতে পারছে না। তার ওপর উজানে বৃষ্টি না হওয়ায় নদীতে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলোও সৃষ্টি হচ্ছে না। মূলত এই দুই কারণে মা মাছ পূর্ণমাত্রায় ডিম ছাড়ছে না।"
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম জানান, কর্ণফুলীতে উপর থেকে নেমে আসা পানির চাপ কম থাকায় সাগরের পানি ঢুকছে। ফলে হালদায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিসাবে, মঙ্গলবার (১৬ মে) কাপ্তাই হ্রদে পানির উচ্চতা ছিল ৭৩ দশমিক ৮২ ফুট এমএসএল (মিন সি লেভেল)। অথচ রুলকার্ভ অনুযায়ী (সময়সূচিভিত্তিক পানি ওঠানামার মাপ) থাকার কথা ছিল ৭৯ দশমিক ১৫ ফুট। সংশ্লিষ্টদের মতে, গত এক দশকের মধ্যে হ্রদটির পানি এবারই সবচেয়ে বেশি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, একারণে কর্ণফুলীতে কমেছে উজানের পানি প্রবাহ। ফলে সমুদ্রের লবণপানি হালদার সাত্তার ঘাট ও কর্ণফুলীর মোহরা পানি শোধনাগার পর্যন্ত চলে আসছে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা হারুনর রশিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী দেশের আকাশে শক্তিশালী পূর্ণাঙ্গ ক্রান্তীয় বৃষ্টিবলয় সক্রিয় আছে। যার ফলে চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক স্থানে ঝড়, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত হচ্ছে; যা ২৪ মে পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। জেলায় এখন স্বাভাবিক তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
হালদার গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী জানান, পানির তাপমাত্রা ২৭–২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে ১৪–১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকলে তা ডিম দেয়ার উপযোগী হয়। গতকাল (১৬ মে) থেকে শুরু হয়েছে মা মাছের ডিম ছাড়ার চতুর্থ জো, যা ২১ মে পর্যন্ত চলবে। পরবর্তী জুন জো হলো ১ থেকে ৬ জুনে এবং সর্বশেষ জো ১৫ থেকে ২০ জুন। এই সময় বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি হলে এবং পাহাড়ি ঢল নেমে আসলে কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২০ সালে রুই জাতীয় মাছের মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।