গ্যাসের সরবরাহ সংকটে নতুন ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলবে কীভাবে?
অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের জন্য সীমিত সক্ষমতায় চলছে বিদ্যমান গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। এর মাঝেই ঢাকার উপকণ্ঠে, মেঘনাঘাটে অবস্থিত তিনটি নতুন বড় গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়েক মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করতে প্রস্তুত হচ্ছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় মালিকানায় থাকা বিদ্যমান গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ১,৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাসের প্রয়োজন, কিন্তু প্রকৃত সরবরাহ ৯৫০ থেকে ১,০০০ এমএমসিএফে দাঁড়িয়েছে। অপ্রতুল গ্যাস সরবরাহের কারণে অনেক গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে অথবা আংশিক চালু রাখা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) ব্যয়বহুল তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্রেফ অলস বসে থাকা কেন্দ্রের তালিকায় যুক্ত হবে বলে জানান শিল্পসংশ্লিষ্টরা। অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বছরে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা 'ক্যাপাসিটি চার্জ' দিতে হবে সরকারকে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হোক বা না হোক সরকার যে পরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য, সেটিই ক্যাপাসিটি চার্জ। বিপিডিবির নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, চাহিদার অভাবে অলস বসে থাকা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের জন্য গত এক দশকে তারা ৬৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
নির্মাণাধীন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতা ১,৯১৭ মেগাওয়াট। ইতিমধ্যে দুবার কেন্দ্রগুলো নির্মাণের সময়সীমা পেছানো হয়েছে। অবশেষে চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গ্যাস সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা
স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মীয়মাণ নতুন কেন্দ্রগুলোর পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৩২২ এমএমসিএফ গ্যাসের প্রয়োজন। কিন্তু এই চাহিদা কীভাবে মেটাবে, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত নয়। প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানিগুলো। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম কি না, তা নিশ্চিত নয় গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা।
সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট মেঘনাঘাট-২ ৫৮৩ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্টের বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা ছিল ২০২২ সালের আগস্টে। তবে পরে তা পিছিয়ে ২০২৩ সালের মার্চে ঠিক করা হয়। কিন্তু ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ডুয়েল-ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, সামিটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ এই বছরের শুরুতেই শেষ হওয়ার পথে ছিল, কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে এবং শীঘ্রই এ পরিস্থিতির উন্নতির তেমন আশা না থাকায় প্রকল্পটি সম্পন্ন হতে বিলম্ব হচ্ছে।
সামিটের প্রকল্প ঠিকমতো এগোচ্ছে
যোগাযোগ করা হলে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল জানায়, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং তাদের সরঞ্জাম সরবরাহকারী এবং প্রকৌশল, ক্রয় ও নির্মাণ (ইপিসি) ঠিকাদার জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই); ইভাকুয়েশন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অভ বাংলাদেশ ও গ্যাস সরবরাহকারী তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কারণে তাদের প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে।
তবে প্রকল্পটি এখন ঠিকমতোই এগোচ্ছে বলে দাবি করে কোম্পানিটি। এই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানায় তারা।
এর আগে গত বছরের ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণস্থল পরিদর্শন করার সময় সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান ঘোষণা দিয়েছিলেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান গ্যাসের ঘাটতির মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্বালানি কীভাবে পাবে, জানতে চাইলে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিতাস গ্যাসের সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি আছে। ওই চুক্তিতে গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'অস্থিতিশীল দামের কারণে সরকার এলএনজি আমদানি স্থগিত রাখায় গ্যাসের ঘাটতি হয়েছে। তবে দাম কমতে শুরু করেছে।'
সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ছাড়াও স্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী ইউনিক গ্রুপ ও ভারতীয় বহুজাতিক অবকাঠামো কোম্পানি রিলায়েন্সের অর্থায়নে আরও দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ সময়মতো সম্পন্ন হয়নি। ওই দুটি কেন্দ্রের সম্মিলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১,৩৩৪ মেগাওয়াট।
সামিটের মেঘনাঘাট-২ পাওয়ার প্ল্যান্টের কাছে অবস্থিত ইউনিক গ্রুপ ও রিলায়েন্সের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহের জন্য গ্রুপ দুটির সঙ্গে পৃথক গ্যাস সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তিতাস গ্যাস।
৫২০ মিলিয়ন ডলারের ইউনিক গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম প্রথমে ২০২২ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৯২ শতাংশ। দুবার ডেডলাইন মিস করলেও গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্পটিকে কোনো জরিমানা করেনি।
তিতাসের ঘাটতি ৩১৯ এমএমসিএফ
বর্তমানে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের ২০টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ৭৫০ এমএমসিএফ গ্যাস প্রয়োজন দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস গ্যাসের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন ৩১৯ এমএমসিএফ ঘাটতিতে আছে। জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাসের সরবরাহ কম পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ৪৩১ এমএমসিএফের বেশি সরবরাহ করতে পারে না।
তিতাস কীভাবে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা করছে, জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লা টিবিএসকে বলেন, পেট্রোবাংলা থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস পেলেই কেবল তারা বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করবেন।
বিপিডিবির বোঝা আরও ভারী হবে
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা বিপিডিবির আর্থিক বোঝা ভারী হয়ে উঠবে। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে বিপিডিবিকেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির আওতায় কোম্পানিগুলোকে যদি গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত থাকে, তাহলে সক্ষমতা বসিয়ে রাখার জন্য বিপিডিবিকে জরিমানা গুনতে হবে।
গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না করে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির সদস্য (জেনারেশন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও তিনি বলেন যে, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক পরিচালনার জন্য মূল ইস্যু জ্বালানি সরবরাহ নিরাপত্তা নয়—এটি একাধিক স্টেকহোল্ডারের নানা ধরনের প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে।