তিন দশকে ঢাকা উত্তরে ৬৬% সবুজ এলাকা কমেছে: সমীক্ষা
যেকোনো শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পার্ক, খেলার মাঠ এবং শহুরে বনাঞ্চলের মতো সবুজ এলাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন দশকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে এমন সবুজ এলাকার পরিমাণ কমেছে ৬৬ শতাংশ।
১৯৯২ সালে ঢাকার উত্তর অঞ্চলে ৯২.২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল গাছপালা, যা ২০২২ সালে এসে প্রায় ৬৬ শতাংশ কমে ৩১.৪০ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। গত ৯ মে মার্কিন-ভিত্তিক জার্নাল পিএলওএস সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশনে প্রকাশিত 'প্রোসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অফ অ্যাচিভিং সাস্টেইনেবল আরবান গ্রিন স্পেসেস: আ কেস স্টাডি অফ আরবান গ্রিনিং ইন ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।
১৯৯২ সালে ঢাকার উত্তরের ১৯৪.২ বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ৪৭ শতাংশই ছিল সবুজ, যা ২০০২ সালে ৩১ শতাংশ, ২০১২ সালে ১৮ শতাংশ এবং ২০২২ সালে আরও কমে ১৬.১৭ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।
সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা উত্তরে ধূসর এলাকা (শহুরে অঞ্চল, যেখানে গাছপালা নেই) ১৯৯২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে; একই সময়ে এ অঞ্চলে জলাশয় কমেছে ৩২.৪ শতাংশ।
এছাড়া, ঢাকা উত্তরে গাছ লাগানোর মতো অনুর্বর ভূমি এলাকা ২০১২ সালের প্রায় ১১ বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে ২০২২ সালে ২.২ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাশুরা শাম্মী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরহাদুর রেজা গবেষণাটি পরিচালনা করেন। সহকারী গবেষক হিসেবে ছিলেন অ্যারিস্টল চন্দ্র সরকার ও আবিদ আজাদ সাকিব।
গবেষকরা মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপের ডেটাবেস থেকে ল্যান্ডস্যাট ডেটা (পৃথিবীর উপগ্রহ চিত্র) ব্যবহার করেছেন।
"ঢাকার সবুজ এলাকা দিনে দিনে যেভাবে সংকুচিত হচ্ছে, ঢাকায় আর কিছুদিন পর সবুজ এলাকা থাকবেই না। ঢাকা উত্তরের তুলনায় ঢাকা দক্ষিণে সবুজ এলাকা কম। আমরা এখন ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় একটি গবেষণা পরিচালনা করছি এবং সেখান থেকে আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তা আরও উদ্বেগজনক," ফরহাদুর রেজা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন।
এই গবেষক আরও জানান, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আবাসন নির্মাণের কারণে ঢাকার সবুজ এলাকা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে উন্নয়ন প্রকল্প ও সরকারি পরিষেবার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।
এছাড়া, বিদ্যমান সবুজ এলাকাগুলোকে সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে রক্ষা করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে ঢাকার মোট এলাকার ৪৪.৮ শতাংশ ফাঁকা জায়গা ছিল, যা ২০০৫ সালে মাত্র ২৪.৫ শতাংশে নেমে আসে। গবেষকরা ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষাকে উদ্ধৃত করেছেন; ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ব্যস্ততম কেন্দ্রের প্রায় ৮৮ শতাংশ এলাকাই সবুজ অঞ্চল বা জলাভূমি ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে।
অপর্যাপ্ত গাছপালা কারণে বর্তমানে ঢাকা শহরের কার্বন সিকোয়েস্টেশন (বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইড ধারণ ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া) অবস্থা অসন্তোষজনক। উচ্চ-তাপমাত্রার দিনে মাঝারি আকৃতির সবুজ এলাকার শীতল এবং আর্দ্রতাকরণ প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণায়।
বলা হয়েছে, স্থানীয় শীতলতা এবং আর্দ্রতার ক্ষেত্রে সবুজ এলাকার জলাধার অববাহিকাগুলোর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।
ঢাকার সবুজায়নে করতে আরও উদ্যোগ জরুরি
সমীক্ষায় কর্তৃপক্ষকে টেকসই উন্নয়নের ১১ নং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, স্থিতিস্থাপক এবং টেকসই শহর গড়ে তুলতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সরকার ইতোমধ্যে 'খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, পার্ক এবং জলাশয় সংরক্ষণ আইন ২০০০' এবং 'পাবলিক ওয়াটার বডি ম্যানেজমেন্ট পলিসি ২০০৯'- এর মতো নীতি ও আইনের মাধ্যমে জলাশয় রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে।
হাতিরঝিল এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পসহ সরকারের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন জলাভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ঢাকা উত্তরের প্রাকৃতিক জলাশয় রক্ষার কাজ চলছে।
ঢাকা উত্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী দুই বছরে এই এলাকায় ২ লাখ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্টের কারণে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা মোকাবেলায় একজন চিফ হিট অফিসারও নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউনেপ) অনুসারে, একটি আদর্শ শহরের অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা হওয়া উচিত, কিন্তু এর বিপরীতে ঢাকা উত্তরে রয়েছে মাত্র ১৬.১৭ শতাংশ।
দুই কোটিরও বেশি লোকের বসবাস ঢাকায়; গত ২০ বছরে এই শহরের তাপমাত্রা প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। 'সারফেস আরবান হিট আইল্যান্ড ইন্টেনসিটি (এসইউএইচআইআই) ইন ফাইভ মেজর সিটিস অফ বাংলাদেশ: প্যাটার্নস, ড্রাইভারস অ্যান্ড ট্রেন্ডস' শীর্ষক সমীক্ষায় জানানো হয়েছে এ তথ্য।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা শহর গঠনে এবং শহুরে এলাকার তাপীয় পরিবেশকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই শহরাঞ্চলের আকার বৃদ্ধির পাশাপাশি বনাঞ্চল কেটে ফেলার জন্য অনেকাংশেই জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিই দায়ী।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও আঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত 'পলিটিকাল ইকোনোমি অফ আরবান গ্রিন স্পেসেস অফ ঢাকা সিটি' শীর্ষক আরেক গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার মাত্র ৮.৫ শতাংশ ভূমিতে গাছপালা রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাশেম টিবিএসকে বলেন, সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে ১৯৯২ সালে এলাকায় অনেক ব্যক্তিগত কৃষিজমি ছিল। তবে এই এলাকার একটি বিশাল অংশ এখন ধূসর স্থানে (গ্রে স্পেস) রূপান্তরিত হয়েছে।
"তবে আমি মনে করি, গত কয়েক বছরে ঢাকা উত্তরে পাবলিক গ্রিন স্পেসও বেড়েছে। আমরা বেশ কয়েকটি পার্ক সংরক্ষণ করেছি। আমরা খাল পুনরুদ্ধার করছি এবং এগুলোর তীরে গাছ লাগাচ্ছি; এতে করে সবুজ এলাকা বাড়াছে," যোগ করেন তিনি।