১৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, তবু অল্পবৃষ্টিতে নাকাল চট্টগ্রাম
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রামেও দিন তিনেক আগে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। তীব্র তাপদাহের মধ্যে স্বস্তির বৃষ্টি নামলেও নতুন দুর্ভোগ হিসেবে যুক্ত হয়েছে জলাবদ্ধতা। কিন্তু ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের ধকলও নিতে পারেনি বন্দরনগরী। শহরের বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় নাগরিক দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণে।
নগরবাসীর অভিযোগ, প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে অন্তত চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিন সংস্থা। তবুও অল্প বৃষ্টিতেই নগরী ডুবে যাওয়ায় হতাশ সাধারণ মানুষ।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ সুমন সাহা বলেন, "মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। এখন থেকে নিয়মিত বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে। শুক্রবার থেকে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৬২ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী কয়েকদিন বৃষ্টিপাতের প্রভাব থাকতে পারে।"
এই অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর ওয়াসা, জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, মেহেদিবাগ, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, চাঁদগাওসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায়।
চট্টগ্রামে মোট ৫৭টি খালের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশিত হয় বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী নদী ও হালদা নদীতে। এর মধ্যে প্রধান ৩৬টি খালে সংস্কার, পুনরুদ্ধার, খনন, দেয়াল নির্মাণ, জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রণে রেগুলেটর স্থাপনের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দুটি, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবি) একটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ৮ বছরে চট্টগ্রামে বড় চারটি প্রকল্প নেয়া হলেও সুফল মিলছে না। কারণ সমন্বয়হীনতা, সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, দীর্ঘসূত্রিতা, মাঝপথে নকশা পরিবর্তন ও প্রকল্পকাজের ধীরগতি।
বড় প্রকল্পের শেষের দিকে নতুন সমস্যার উদয়
'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' শীর্ষক জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বড় প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ২০১৭ সালে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি নির্ধারণ করা হয়। ৫ বছর পর ২০২২ সালে প্রকল্পব্যয় এক লাফে ৭০ শতাংশ বেড়ে ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকায় পৌঁছে। প্রকল্পটির অধীনে ৩৬টি খাল খনন-সংস্কার, ১৭৬ কিমি রিটেইনিং ওয়াল, ৪৫টি ব্রিজ, ড্রেন ও ফুটপাত নির্মাণের কথা রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।
প্রকল্প পরিচালক ও সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লে. কর্নেল মো. শাহ আলী টিবিএসকে বলেন, "শহরে মোট ১৬০০ কিলোমিটার ড্রেন ও ৫৭টি খাল আছে। আমাদের প্রকল্পের অধীনে ৩৬টি খাল ও ৩০০ কিলোমিটার ড্রেন আছে। এসব খাল ও ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার। খালে মাটি বা বাঁধ নেই। পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে হলে পুরো ১৬০০ কিলোমিটার ড্রেন ও ৫৭টি খাল পরিষ্কার রাখতে হবে। সেগুলো তদারকির দায়িত্ব আমাদের না।"
বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে চলতি বছরের ২ মে জলাবদ্ধতা নিরসনের সবচেয়ে বড় প্রকল্প নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন সংশ্লিষ্টরা। ওই সময় বলা হয়েছিল- মোট ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির কাজ করছে সিডিএ। বাকি ২১টি খালের কাজ না হওয়ায় তা জনগণকে ভোগাবে। যদিও সংবাদ সম্মেলনে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেছিলেন, "এবার তেমন জলাবদ্ধতা হবে না।" তবে গত দু'দিনের অল্প বৃষ্টিপাতে ধকল সইতে পারেনি নগরী।
এদিকে প্রকল্পটির শেষদিকে নতুন করে ২১ খালের বিষয়টি সামনে আসায় সুফল নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পটি নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল- ৩৬টি খালের সংস্কার করলেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে। প্রকল্পের কাজ শেষের দিকে এসে এখন কেন ২১টি খাল সামনে আসছে? প্রকল্পের সুফল নিয়ে সন্দেহ জাগছে! প্রকল্পকাজ শুরুর পর থেকে প্রতি বছর বলা হয়েছিল, আগামী বছর জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা হয়েছে। এজন্য জনগণ এখন তাদের বিশ্বাস করে না। আমিও বিশ্বাস করি না।"
"২১টি খালের সংস্কার যদি অপরিহার্য হয়, তাহলে প্রকল্প সংশোধন করে সেগুলো আওতায় আনা হয়নি? অনেক প্রকল্প তো রিভাইস করা হয়েছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর ভারী বর্ষণ হবে না। এজন্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু হালকা বর্ষণে সড়কগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। যদি মাঝারি বর্ষণ ও জোয়ার একসঙ্গে হয়, তাহলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে," যোগ করেন তিনি।
অন্য প্রকল্পেও জটিলতা-ধীরগতি
চট্টগ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক হাজার ৬২০ কোটি টাকার প্রকল্পটির চার বছরে অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। প্রকল্পটির অধীনে ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর বসানোর পাশাপাশি কর্ণফুলীর তীরে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণের কথা ছিল।
কিন্তু প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তুলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশ জানিয়েছে। সংস্থাগুলো বলছে, প্রকল্প অনুসারে নদীর তীরের সড়কটি ৬ মিটার পর্যন্ত উঁচু করলে আশপাশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, জেটি, ওয়াগন শেড, পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত রেললাইন অস্বাভাবিক নিচু হয়ে যাবে। ফলে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া এতোগুলো স্থাপনা উঁচু করাও অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ কাজ। এছাড়া নদীতীরের সম্পূর্ণ অংশে বন্যা প্রতিরোধক দেয়াল দিলে জেটিগুলোতে জাহাজ ভিড়তে বাধাগ্রস্ত হবে। এসব আপত্তি ও পর্যবেক্ষণ গত বছরের ২৮ আগস্ট পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার। চলতি মাসে প্রকল্প মেয়াদ শেষ হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী শিবেন্দু খাস্তগীর টিবিএসকে বলেন, "আপত্তির বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রকল্পের কাজ আগের নকশায় চলছে।"
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট ব্রিজ থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ পাঁচ বছরে তিনদফা বাড়লেও কাজ শেষ হয়নি। এরমধ্যে দুই দফায় প্রায় ৪৭১ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। এছাড়া গত বছর প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন ১৮ ধরনের স্থাপনা যুক্ত করা হয়। প্রকল্পটির অধীনে ৯ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপন, ড্রেন, ওয়াকওয়ে, পাম্প হাউজ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মাণের কথা রয়েছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ।
প্রকল্প পরিচালক সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পের কাজ ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। খালের মুখে রেগুলেটর বসানোর গেটগুলো আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বিদেশ থেকে আসবে। তবে চলতি বর্ষার কথা মাথায় রেখে লোকাল গেট বসিয়ে এ মাসেই চার খালের মুখে রেগুলেটর চালু করা হবে। পরে বিদেশিগুলো এলে সেগুলো স্থাপন করা হবে।"
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প ৯ বছরেও শেষ হয়নি। ২০১৪ সালে অনুমোদিত প্রকল্পটি প্রায় সাত বছর ধরে ঝুলে আছে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায়। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফরহাদুল আলম বলেন, "মোট ২৫ একর জমির মধ্যে ২০ একর বুঝে পেয়েছি। প্রকল্পের কাজ চলছে। অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ।"