বকেয়া টাকা দিচ্ছে না রেল, ১৩ বছর ধরে প্রতীক্ষায় ৬২৯ কৃষক!
গাইবান্ধার বালাসী ঘাটের বাসিন্দা ছুকু মিয়া (৬৫)। তার ৬৫ শতক কৃষিজমির সবটুকুর উপর দিয়ে গেছে রেললাইন। শর্ত ছিল জমির ফসলের বিপরীতে প্রতিবছর টাকা দিবে রেল কর্তৃপক্ষ। শুরুতে কয়েক বছর দিয়েছেও। কিন্তু গত ১৩ বছর সে কথা রাখেনি রেল কর্তৃপক্ষ। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ধর্না দিয়েও পাওনা বুঝে পায়নি ছুকু মিয়া। ফেরত পায় নি জমিও। কারণ অস্থায়ীভাবে অধিগ্রহণ করা তার জমির উপর দিয়ে রেললাইন এখনো বহমান। এটিই ছুকু মিয়ার জীবনে এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু ছুকু মিয়া নয়, গাইবান্ধার ফুলছড়ির ছয় শতাধিক কৃষক এই রেললাইনের ঘানি টেনে বেড়াচ্ছেন। ১৩ বছরে তাদের কাছে রেল প্রায় ৬ কোটি টাকা ঋণে রয়েছে। অন্যদিকে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে রেলের প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পদ। এই লাইনের অবস্থান গাইবান্ধার বালাসী থেকে ত্রিমোহিনী পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য সাড়ে ৮ কিলোমিটার।
১৯৯৬-৯৭ সালে ৬২৯ জন কৃষকের কাছ থেকে ভাড়া পরিশোধের শর্তে ১৪৫ দশমিক ৭৩ একর জমি অস্থায়ী হুকুম দখল করে স্থাপন করা হয় এই রেলপথ। এরপর প্রথম ১৩ বছরে ভাড়া বাবদ প্রায় ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে গত ১৩ বছর ধরে ভাড়া বকেয়া রেখেছে রেল বিভাগ।
১৩ বছর আগেও নদীপথে রেলফেরির মাধ্যমে ট্রেন চলাচল করতো গাইবান্ধা থেকে জামালপুরে। বিভিন্ন মালামাল কিংবা যাত্রী পরিবহনে অনবদ্য ভূমিকাও রেখেছিল এ পথ। এই পথে উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলার হাজার হাজার মানুষ রেলফেরিতে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ করত। নদীপথে পরিবহন খরচ কম হওয়ায় সেসময় এ পথে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্যও করেছেন ব্যবসায়ীরা।
মূলত ১৯৩৮ সালে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বৃটিশ সরকার বর্তমান গাইবান্ধার ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাট থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রে রেলফেরি সার্ভিস চালু করে। তখন গাইবান্ধার বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশন থেকে তিস্তামুখ ঘাট পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়। ১৯৯০ সালের পর ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্য সঙ্কটের কারণে গাইবান্ধা অংশে ফেরি সার্ভিসটি ফুলছড়ির তিস্তামুখঘাট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বালাসীঘাটে স্থানান্তর করা হয়।
এবার প্রয়োজনের তাগিদেই স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে ১৪৫ দশমিক ৭৩ একর জমি অস্থায়ীভাবে হুকুম দখল করে ত্রিমোহনী থেকে বালাসী পর্যন্ত সাড়ে ৮ কিলোমিটার এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়।
এই রেলপথের বেড়াজালে আটকে দিশেহারা ছুকু মিয়ার সংসারে এখন অভাব-অনটন লেগেই থাকে। জানালেন, এখন চাষাবাদ করার মতো এক শতক জমিও নেই তার। দুই ছেলে না থাকলে তাকে পথে বসতে হতো। সংসার চলে তার দুই ছেলের গার্মেন্টসের চাকরি দিয়ে। শেষ জীবনে এসে তার পাওনা টাকা সরকারের কাছে দাবি করেন তিনি।
ব্রহ্মপুত্র নদীর ভাঙনে প্রায় নিঃস্ব মজিবর রহমান মন্টুর এক একর ৩৫ শতক জমি পড়েছে একই রেললাইনে। তিনি বলেন, "গত ১৩ বছর ধরে রেল কোনো টাকা পয়সা দেয় না। কবে দিবে তার কোনো হিসাব নেই। আমরা ক্লান্ত। সরকারের কাছে দাবি আমাদের পাওনাসহ জমি ফেরত চাই।"
ফুলছড়ির কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল হামিদের দাবি, তারা আত্মীয়-স্বজন মিলে রেলের কাছে প্রায় দেড় কোটি টাকা পাবেন। শুধু বালাসী ঘাটেই সাড়ে সাত বিঘা জমি রেললাইনে পড়েছে।
বলেন, "টাকা তুলতে গেলে ঘুষ চাইছে তাও দিয়েছি। ডিসি (জেলা প্রশাসন) অফিস, লালমনিরহাট, রাজশাহী সব জায়গাতেই আমরা গিয়েছি। কিন্তু তারপরও কোনো কাজ হয়নি।"
বালাসীঘাটের মফিজার হক সরকারের চার বিঘা জমি রেললাইনের মধ্যে পড়ে আছে। তিনি জানান, বহু চেষ্টা করেও টাকা উদ্ধার করতে পারেননি। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি মিলে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা এসব কথা কানে তোলেন না। শুধু তাই নয়, সরকারি সম্পদ রেল কীভাবে নষ্ট হচ্ছে তাও দেখার কেউ নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রেলের উপর গড়ে উঠেছে শত শত অস্থায়ী বসতবাড়ি। মাটি সরে কোথাও আবার ঝুলে আছে রেল। নাট-বল্টু, স্লিপারের মতো মূল্যবান যন্ত্রাংশের হদিস নেই অনেক জায়গায়। গোটা রেলপথ জুড়ে চোখে পড়ল না একটি পাথরও। এভাবে নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ।
শর্ত অনুযায়ী, রেলে হুকুম দখলের মাধ্যমে নেওয়া জমির জন্য কৃষকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে। তবে এ কাজে সহযোগিতা করবে জেলা কৃষি বিভাগ। তারা প্রতি বছর ত্রিমোহনী-বালাসী রেলের জমিতে ফসলের মূল্যমান নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসনকে প্রাক্কলন দিবে। সে অনুযায়ী কৃষকদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু কৃষি বিভাগ বলছে, গত কয়েক বছর ধরে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে কেউ জানতে চায়নি। গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, "আমি কয়েকমাস আগে এখানে যোগদান করেছি। এ সংক্রান্ত কোনো নথির খবর জানি না।"
আর গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন বলছে, কয়েক বছর আগে বারবার তাগিদ দিয়েও জমি ভাড়ার বকেয়া টাকা পরিশোধ করেনি রেল কর্তৃপক্ষ। জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ত্রিমোহনী-বালাসী রেলে হুকুম দখল করা কৃষকের টাকা দেওয়ার জন্য বাংলা ১৪১৭, ১৪১৮ ও ১৪১৯ সালের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রাক্কলন করে রেল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কৃষকের পাওনা বুঝিয়ে দেয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ত্রিমোহনী-বালাসী ঘাটে আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে তিস্তামুখ ঘাট থেকে বোনারপারা স্টেশন রুটে ট্রেন চলাচল। সেখানেও অলস পড়ে থাকায় জরাজীর্ণ হয়ে নষ্ট হচ্ছে রেলসহ মূল্যবান সম্পদ। ত্রিমোহনী-বালাসী ও তিস্তামুখ-বোনারপাড়া রেলের বন্ধ রুট দুটিতে প্রায় ১৭ কিলোমিটার রেলপথে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার সরকারি সম্পদ পড়ে আছে বলে জানিয়েছে রেলের একটি সূত্র।
তবে পরিত্যক্ত রেল অপসারণ আর জমি ভাড়া বাবদ বকেয়া পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। গাইবান্ধার এই রেলপথের দেখাশোনা করে সংস্থাটির লালমনিরহাট অঞ্চল (পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক বিভাগ)।
লালমনিরহাট অঞ্চলের প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, "এই পথে ওয়াগন বহনের জন্য ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘাটের কার্যক্রম চালু ছিল। আর যাত্রী পরিবহন হয়েছে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। এই রেলপথের কৃষকদের ক্ষতিপূরণ আগে আমরা প্রতি বছর দিতাম। গত কয়েক বছরের কৃষকের পাওনা টাকা বকেয়া রয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে প্রাক্কলন চেয়েছি। এটি পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে কৃষকের টাকা পরিশোধ করা হবে।"