আবারো আন্দোলনে রানিং স্টাফরা, ট্রেন চলাচল ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা
রেলওয়ের মাইলেজ ইস্যুতে আবারো আন্দোলনে নামছেন রানিং স্টাফরা। মাইলেজ সুবিধা বহাল রাখার বিষয়টি ঘোষণা দেয়ার এক বছর পার হয়েছে। তবে এখনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। ফলে পেনশন নিয়ে জটিলতায় পড়ছেন অবসরে যাওয়া কর্মীরা।
প্রজ্ঞাপন জারি না হলে আগামী ২৭ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি ঘোষণা করেছেন ট্রেন চালক, গার্ডসহ সরাসরি ট্রেন পরিচালনার কাজে নিয়োজিত রানিং স্টাফরা। ফলে রেল সেবা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ বর্তমানে চাহিদার মাত্র ৪৩ শতাংশ রানিং স্টাফ রয়েছে। তাদের দিয়ে অতিরিক্ত ডিউটি করিয়ে চলছে রেল সেবা কার্যক্রম।
এর আগে গত ২৩-২৯ জুলাই পর্যন্ত নির্ধারিত ৮ ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন থেকে বিরত ছিলেন রানিং স্টাফরা। এতে পণ্যবাহী ও লোকাল ট্রেন চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রংপুর সফরের সময় যেন ট্রেন চলাচলে ব্যাঘাত না ঘটে, এজন্য তারা কর্মসূচি বাতিল করেছিল।
ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগ সেবাখাত রেলওয়ে মূলত রানিং শেড ম্যানুয়াল এবং স্টাবলিশডমেন্ট কোড অনুসারে পরিচালিত হয়। সংস্থাটিতে টেকনিক্যাল ও দাপ্তরিক অনেক শাখা থাকায় নিজস্ব নিয়মে চলছে ১৮৬২ সাল থেকে।
জটিলতার শুরু যেখান থেকে
রেলের নিয়মানুযায়ী, দৈনিক রানিং স্টাফরা ৮ ঘণ্টা অথবা চলন্ত ট্রেনে ১০০ মাইল ডিউটি পালন করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ট্রেন চালকসহ (লোকো মাস্টার) রানিং স্টাফরা অতিরিক্ত প্রতি ৮ ঘণ্টা ডিউটির জন্য একদিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ মাইলেজ ভাতা পেয়ে আসছেন। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ডিউটি করলে ১২ দশমিক ৫০ মাইল যুক্ত হতো তাদের নামে। ৮ ঘণ্টায় ১০০ মাইল যুক্ত হতো। হেডকোয়ার্টারে (নিয়োগকৃত স্টেশন) নির্ধারিত ডিউটির পর টানা ১২ ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে থাকেন রানিং স্টাফরা। আর হেডকোয়ার্টারের বাইরে অন্য স্টেশনে বিশ্রামের সময় পান টানা ৮ ঘণ্টা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে রানিং স্টাফদের ডিউটি করতে বাধ্য করা যায় না। তবে বিশ্রামের সময়ে অর্থাৎ আন্ডাররেস্টে ডিউটিতে যোগ দিলে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ মাইলেজ ভাতা (একদিনের মূল বেতনের অর্ধেক) পান। ডিউটির সময়ের কর্মঘণ্টাও যুক্ত হতো ওভারটাইমে। এছাড়া অবসরের পর মূল বেতনের সঙ্গে ৭৫ শতাংশ মাইলেজ ভাতা যুক্ত করা হতো। সে অনুসারে পেনশন ও আনুতোষিক পরিশোধ করা হতো।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের ১০০ মাইলের বেশি অথবা ৮ ঘণ্টার অধিক সময় দায়িত্ব পালনের জন্য দৈনিক মূল বেতনের ৭৫ শতাংশের বেশি রানিং ভাতা প্রদান বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। দায়িত্ব পালন করলেও মাইলেজ ভাতা ৩০ কর্মদিবস অর্থাৎ ৩০০০ মাইলের বেশি বিবেচনা করা হবে না। অবসরের পর রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক হিসাবের ক্ষেত্রেও মূল বেতনের সঙ্গে ৭৫ শতাংশের বেশি যুক্ত করার বিষয়ে অসম্মতি জানানো হয় ওই আদেশে। ফলে দীর্ঘ ১৬০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা নিয়ম বাতিল হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলের পরিবহন বিভাগের রানিং স্টাফদের মধ্যে যথাক্রমে লোকোমাস্টার (এলএম), সহকারী লোকোমাস্টার (এএলএম) ও সাব লোকোমাস্টার বা শান্টিং লোকোমাস্টার (এসএলএম), ক্যারেজ অ্যাটেনডেন্ট, গার্ড, টিকিট ট্রেকার (টিটিই) রয়েছেন। ট্রেন পরিচালকদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত তারা। রেলের কর্মী সংকট দীর্ঘদিনের। এ কারণে রানিং স্টাফদের অতিরিক্ত ডিউটি করিয়ে চলছে রেল সেবা। নতুন নিয়মে মাইলেজ ভাতা মাসে সর্বোচ্চ ৩০ দিন বা ৩০০০ মাইল সীমিত করায় অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। যেমন: অনেক রানিং স্টাফ বেশি ডিউটি করে মাসে ৭-৮ হাজার মাইলও অর্জন করছেন।
রেলওয়ের তথ্যমতে, রেলের দুই অঞ্চলে বর্তমানে রানিং স্টাফদের মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৩৬৮৫টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১৫৯৭ জন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় মাত্র ৪৩ শতাংশ পদে কর্মী আছে। রানিং স্টাফদের মধ্যে লোকোমাস্টার (এলএম), সহকারী লোকোমাস্টার (এএলএম) ও সাব লোকোমাস্টার (এসএলএম) পদের সংখ্যা ২২৩৬টি। বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৮৫০ জন। ট্রেন চালানোর কাজে নিয়োজিত জনবলের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৩৮ শতাংশ আছে। এজন্যই ট্রেন পরিচালনায় অতিরিক্ত ডিউটি করতে হয় রানিং স্টাফদের।
বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি ঘোষণা, অবসরের পর হয়রানি
২০২১ সালের নভেম্বরের নতুন ঘোষণার পর থেকে আন্দোলনে নামেন রানিং স্টাফরা। ২০২২ সালে জানুয়ারিতে কয়েক দফা আন্দোলন করেন, অতিরিক্ত ডিউটি বন্ধ করে দেন। তখনও আশ্বাস দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আগের নিয়মে বেতন-ভাতার বিষয়টি আদায় করেন তারা। তবে ১০ এপ্রিল পেনশন ও আনুতোষিক হিসাবে মাইলেজ সুবিধা যুক্ত করার বিষয়ে অসম্মতি জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। কর্মবিরতি করেন রানিং স্টাফরা। আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ১৩ এপ্রিল রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলামসহ দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এছাড়া নতুন প্রজ্ঞাপন জারির ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে রেলওয়ের ২০২১ সালের ৩ নভেম্বরের প্রজ্ঞাপনটি এখনো বাতিল করা হয়নি। এক বছর পার হলেও আগের নিয়ম পুনর্বহালের বিষয়েও কোন ঘোষণা আসেনি। আগের নিয়মে বেতন-ভাতা পেলেও অবসরপ্রাপ্ত রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা মো. নজরুল ইসলাম গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অর্থ) বরাবর এক চিঠিতে জটিলতার বিষয়টি উল্লেখ করেন। ওই চিঠির তথ্যমতে, ২০২১ সালের নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে রানিং স্টাফদের মাইলেজ ভাতা সীমিত করা হয়। তবে অবসরে যাওয়া কর্মীরা মূল বেতনের সঙ্গে ৭৫ শতাংশ মাইলেজ ভাতা পাবেন না। এটিকে অনুসরণ করে রানিং স্টাফদের পেনশন প্রাপ্যতা নির্ধারণের বিষয়ে ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ নির্দেশনা জারি করে। এরপর আন্দোলনের মুখে ১৩ এপ্রিল তা আবার প্রত্যাহার করা হয়। এরপর নতুন প্রজ্ঞাপন জারির কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এজন্য পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২০ জন রানিং স্টাফের অবসরের পেনশন নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
রেলওয়ে শ্রমিকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, "রেল পরিচালিত হয় রানিং শেড মেন্যুয়াল এবং স্টাবলিশডমেন্ট কোড অনুসারে। কর্মচারীদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে এসব বিধির মানা হলে বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদানের ক্ষেত্রে কেন একই নিয়ম মানা হবে না! তাহলে যেটায় আপনাদের সুবিধা, সেটা মানছেন! প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলে এমন আরো অনেক জটিলতা সামনে আসবে।"
এখনো মেন্যুয়ালে বেতন পান রানিং স্টাফরা
১৮৬২ সাল থেকে রেলওয়েতে স্বতন্ত্র বেতন-ভাতা কাঠামোর প্রথা প্রচলিত। করোনা মহামারির সময় অর্থসংকটে পড়ায় সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সফটওয়্যার আইবাস প্লাস প্লাস এর আওতায় আনা হয়। অর্থাৎ ২০২১ সাল থেকে সফটওয়্যারের মাধ্যমে বেতন পান সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু মাইলেজ জটিলতা নিরসন না হওয়ায় রানিং স্টাফরা এখনো মেন্যুয়াল পদ্ধতিতে বেতন পান। অর্থচ রেলের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আইবাস প্লাস প্লাসের মাধ্যমে বেতন-ভাতা পান। রানিং স্টাফদের অভিযোগ, মেন্যুয়াল পদ্ধতির কারণে বিলম্বে বেতন-ভাতা পান তারা।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা এএইচএম শামসুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "রানিং স্টাফদের অনেকের মাইলেজ ভাতা মূল বেতনের চেয়ে বেশি আসে। আইবাসে ভাতা মূল বেতনের বেশি প্রদানের সুযোগ নেই। এ কারণে অনেকের বেতন আইবাসে দেয়া হচ্ছে। আবার ভাতা মেন্যুয়ালে দেয়া হচ্ছে। আবার কারো কারো বেতন-ভাতা উভয়ই মেন্যুয়ালে দেয়া হচ্ছে।"
নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে মাইলেজ সুবিধা রহিত
রেলওয়ের তথ্যমতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রজ্ঞাপন জারির পর গত দেড় বছরে রেলওয়ের সরকারী লোকোমাস্টার পদে বিভিন্ন পরীক্ষার পর ২৯৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২৪১ জন কাজে যোগদান করেছেন। চাকরিতে যোগদানের পর দুই বছর শিক্ষানবিশ রেখে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর তাদের ওপর ট্রেন চালানোর ভার ছাড়া হয়। সর্বশেষ তথ্যমতে, ২৪১ জনের মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৮০ জন চাকরিতে আছেন। বাকিরা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
রেলের রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের নেতাদের অভিযোগ, সুযোগ-সুবিধা রহিত অনেকে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ নিয়োগপত্রে উল্লেখ ছিল, পূর্বের নিয়মানুয়ী তারা সকল সযোগ-সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ অতিরিক্ত ডিউটি করানোর বিপরীতে তারা মাইলেজ সুবিধা পাবেন। কিন্তু চাকরিতে যোগাদানের সময় স্বাক্ষরিত অফার লেটারে মাইলেজ সুবিধা রহিত করার শর্তজুড়ে দেয়া হয়। এতে দৈনিক ৮ ঘণ্টার পর মাইলেজ ভাতা বিবেচনা করা হবে উল্লেখ করা হয়। অথচ রেলের বর্তমান বিভিন্ন রুটের গন্তব্য ৮ ঘণ্টায় সমাপ্ত হয়। ফলে সহকারী লোকোমাস্টাররা রেলের দীর্ঘ ১৬০ বছরের প্রচলিত মাইলেজ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় আহ্বায়ক মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, "এক বছর আগে প্রজ্ঞাপন জারির কথা ছিল। তা এখনো করা হয়নি। এজন্য অনেকের পেনশন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। আমার আগের নিয়মে ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মানে এখানে ধোঁয়াশা আছে। তাই আমাদের দাবি প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।"
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান টিবিএসকে বলেন, "পেনশন নিয়ে জটিলতার বিষয়টি আংশিক সমাধান হয়েছে। বাকিটাও সমাধানের চেষ্টা চলছে। নতুন সহকারী লোকোমাস্টারদের নিয়োগের সময় যে শর্ত দেয়া হয়, তা মেনেই চাকরি করতে হবে। রানিং স্টাফদের পুরো সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।"