পর্যাপ্ত সুবিধা নেই, গ্রেড সংস্কারেও উদাসীনতা: যোগ দেননি রেলের ২২৫ সহকারী স্টেশন মাস্টার
সরকারি চাকরিতে তুমুল প্রতিযোগতার সময়েও রেলওয়ের সহকারী স্টেশন মাস্টার (এএসএম) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ২২৫ জন কাজে যোগ দেননি। রেলের এ পদে সার্বক্ষণিক কাজ করাসহ দায়িত্বের বোঝা বেশি থাকলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া দীর্ঘ দেড় যুগের বেশি আইনি লড়াইয়ের পর রেলের অন্যান্য পদের সঙ্গে স্টেশন মাস্টারদের বেতন বৈষম্যের সুরাহা হলেও তা বাস্তবায়নে গড়িমসির অভিযোগ রয়েছে।
এসব কারণে চাকরির বাজারে তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যেও নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৮ শতাংশ এএসএম কাজে যোগ দেননি। আর যোগদান করা এএসএম সরকারি অন্যান্য চাকরির চেষ্টা করছেন। ফলে রেলওয়ের দীর্ঘদিনের জনবল সংকট নিরসন হচ্ছে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার ও কর্মচারি ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. মোখলেসুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই পদে অনেক দায়িত্ব। ছুটি নেই। সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করলেও মাইলেজ বা ওভারটাইম সুবিধা নেই। পদোন্নতিতে সময় লাগে। বেতন কাঠামোর সংস্কার হচ্ছে না। এসব কারণে তুলনামূলক নিম্ন গ্রেডের চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন প্রার্থীরা।"
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০২১ সালের আগস্টে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সব প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের ১৩ নভেম্বর সহকারী স্টেশন মাস্টার (এএমএস) পদে মোট ৫৮৭ জনের চূড়ান্ত নিয়োগ হয়। এরমধ্যে ৩৬২ জন কাজে যোগ দিয়েছেন। বাকি ২২৫ জন কাজে যোগ দেননি। যোগদান করাদের ১৮৩ জনকে পূর্বাঞ্চলে ও ১৭৯ জনকে পশ্চিমাঞ্চলে পদায়ন করা হয়। তাদের বড় অংশ বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তারা সর্বশেষ বিসিএস লিখিত পরীক্ষার ছুটিও নিয়েছিলেন। ফলে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের স্থায়ীভাবে থাকা নিয়েও সন্দিহান রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।
নতুন নিয়োগের আগে রেলের মোট ১৬৪০টি স্টেশন মাস্টার পদের বিপরীতে স্থায়ী ৫৯৪ জন এবং চুক্তিভিত্তিক ৭২ জন কর্মরত ছিলেন। বাকি ১০৪৬টি পদই শূন্য ছিল এতোদিন। এর ফলে সারাদেশের মোট ৪৮৪টি স্টেশনের মধ্যে ১১৫টিই বন্ধ। অর্থাৎ জনবল সংকটের কারণে কার্যক্রম সংকুচিত করতে হয়েছে রাষ্ট্রীয় সেবা সংস্থাটিকে।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলওয়ের স্টেশন মাস্টারের অত্যাবশ্যকীয় পদটির দায়িত্ব-কর্তব্য ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন কাঠামো তুলনামূলক নিম্ন গ্রেডের। প্রতিদিন অন্তত ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। জরুরী প্রয়োজনে স্ট্যান্ডবাই স্টেশনে দায়িত্ব পালন করা এবং সকাল-রাতে উভয় শিফটে একনাগাড়ে কাজ করতে হলেও তেমন ছুটি নেই। নেই বাড়তি সুযোগ-সুবিধা। এ পদের মূল বেতন ১৫তম গ্রেড থেকে শুরু। স্নাতক পাশ করা এএসএম থেকে বিভিন্ন ধাপে স্টেশন মাস্টারে পদোন্নতি পেতে সময় লাগে ২০ থেকে ২২ বছর।
সম্প্রতি নিয়োগ পেয়েও এএসএম পদে যোগদান করেননি এমন অন্তত পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলেছেন টিবিএস প্রতিবেদক। তাদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী একজন বলেন, "ডিউটি অনুযায়ী আর্থিক সুবিধা কম। ছুটি নেই। অনেক চাপের চাকরি। জরুরি প্রয়োজনে ছুটি নিতে হলেও রিলিভার (পরিবর্তিত দায়িত্বপ্রাপ্ত) না আসা পর্যন্ত স্টেশন ত্যাগ করা যায় না। আমি এর আগেও লোকোমাস্টার পদে দু'মাস চাকরির পর ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ এখন অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বেশি। ছুটি, ট্রান্সফার, ট্রান্সফার ঠেকানো, পদোন্নতিসহ পদে পদে ঘুষ দিতে হয়। আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি।"
একই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত বরিশালের আরিফুল ইসলাম কাজে যোগ না দিয়ে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসমাঈল হোসেন এএসএমের চেয়ে নিচের গ্রেডে হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে যোগ দিয়েছেন।
এ দু'জন টিবিএসকে বলেন, "বিষয়টি নিয়ে রেলওয়ে কর্মকর্তা ও স্টেশন মাস্টারদের সঙ্গে আলাপ করেছি। অভ্যন্তরীণ অবস্থা, অবমূল্যায়নসহ সার্বিক বিষয়ে জেনেছি। তারা এএসএম পদে যোগ না দিতে পরামর্শ দিয়েছেন।"
বেতন কাঠামো সংস্কারে গড়িমসি
স্টেশন মাস্টাররা বলছেন, ১৯৬২ সালে ঘোষিত রিভাইস পে-স্কেলে (আরপিএস) স্টেশন মাস্টারদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী, রেলওয়ের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, রেলওয়ে হাসপাতালের মেট্রোনসহ সমমান ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের সংস্কারেও বৈষম্য সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭৭ সালের সংস্কারে স্টেশন মাস্টারদের তুলনায় সমমান পদের কর্মীদের উচ্চ গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হয়। এখান থেকেই বৈষম্যের শুরু।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট নথির তথ্যমতে, বেতন বৈষম্য দূর করতে ২০০৫ সালে আদালতে রিট করে রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়ন। এরপর আদালতে রিট, বিপক্ষ রিট, রিট পিটিশন, আপিলসহ আইনি লড়াই শেষে ২০১৭ সালে স্টেশন মাস্টারদের অনকূলে চূড়ান্ত রায় আসে। এরপরও রেলওয়ে রায় বাস্তবায়ন না করায় ফের মামলা করে বাদীপক্ষ। পরে ২০২১ সালে রেলওয়ে ও অর্থ মন্ত্রণালয় রায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়।
২০২০ সালের ২৩ মার্চ রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে রেলের মহাপরিচালককে বেতন কাঠামো সংশোধন সংক্রান্ত একটি সুপারিশ দেয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য। এতে এএসএম (সহকারী স্টেশন মাস্টার) এর বিদ্যমান গ্রেড ১৫ থেকে ১৩ গ্রেডে উন্নীত, এসএম-৪ (স্টেশন মাস্টার-৪) এর বেতন গ্রেড ১৪ থেকে ১৩তম গ্রেডে উন্নীত, এসএম-৩ এর বেতন ১৩ থেকে ১১তম গ্রেডে উন্নীত, এসএম-২ এর বেতন ১২তম থেকে উন্নীত করে ১০তম, এসএম-১ এর বেতন গ্রেড ১১ থেকে উন্নীত করে ১০তম এবং স্টেশন সুপারিনটেন্ডেন্টের বেতন গ্রেড ১০তম থেকে ৯ম গ্রেডে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়।
এ সুপারিশের প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২৬ আগস্ট চিঠিতে স্টেশনমাস্টারদের ৫টি পদের গ্রেড উন্নীত করার সম্মতি দেয় (স্টেশন সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যতীত) অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে রেলের সুপারিশে এএসএমের গ্রেড ১৩ থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয় ১৪তম গ্রেড দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া এসএম-৩ এর ১১তম গ্রেডের পরিবর্তে ১২তম, এসএম-২ এর ১০তম এর স্থলে ১১তম গ্রেড দিতে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এসএম-৪ এর গ্রেড সুপারিশ মোতাবেক ১৩তম গ্রেডই বহাল রেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরও আইন মন্ত্রণালয় থেকে রায়ের ব্যাখ্যা নিয়ে শুধুমাত্র মামলা করা ৫ জনের বেতন কাঠামো সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে।
রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, "আদালতের রিটে সংগঠন বনাম রেলওয়ে ছিল। পাঁচটি পদের জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঁচজন পিটিশনার ছিলেন। সংগঠনের সকল সদস্যরা রায়ের আওতাভুক্ত। কিন্তু রেল বারবার চিঠি চালাচালি অজুহাতে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত করছে।"
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. কামরুল আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্ব উল্লেখ ছিল। অনেকে ভালো চাকরি পেয়েছেন বলে যোগ দেননি। শূন্য পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে।"
বেতন বৈষম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, "আদালতের রায় বাস্তবায়নে রেলওয়ে ও অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এখানে পিটিশনার কী পাঁচজন নাকি সবাই-এ বিষয়ে অষ্পষ্টতা রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছে। দ্রুত ইতিবাচক সমাধান হবে।"