এখন থেকে পদমর্যাদা ও দায়িত্ব অনুযায়ী প্রশিক্ষণ পাবেন সরকারি কর্মকর্তারা
এখন থেকে সরকারি চাকুরিজীবীদের পদমর্যাদা ও দায়িত্ব অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। একইসঙ্গে যার জন্য যে প্রশিক্ষণ নির্ধারণ করা হবে, তাকে সেই প্রশিক্ষণে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে হবে।
এর আগে উপসচিব, সিনিয়র সচিব ও যুগ্ম সচিবরা একই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।
এছাড়া, দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা (মাস্টার্স, এম.ফিল, পিএইচডি) অর্জনের সুযোগ পাবেন সরকারি চাকুরিজীবীরা।
এমন নিয়ম রেখে 'জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষা নীতিমালা-২০২৩' প্রণয়ন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ যাদের জন্য প্রযোজ্য, এই নীতিমালাও তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সহিদউল্লাহ এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, দেশের আর্থ সামাজিক অগ্রগতির প্রেক্ষিতে নতুন নীতিমালা করা হয়েছে। নীতিমালায় সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোভিড মহামারির প্রেক্ষিতে অনলাইনে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা বিষয়ক কোর্স যুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, "উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে মাস্টার্স ও এম.ফিলকে সমমানের করা হয়েছে। আগে একজন চাকরিজীবী একটা মাস্টার্স, সঙ্গে পিএইচডি করতে পারতেন। এতে অনেক সময় তাকে সার্ভিসের বাইরে থাকতে হয় বলে জনগণ বা রাষ্ট্র ওই সময় তার কাছ থেকে সেবা পায় না। এখন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে একজন বিদেশে একটি মাস্টার্স করতে পারবে। আগে একাধিক মাস্টার্স করার সুযোগ ছিল। তবে দেশের ভেতরে একাধিক মাস্টার্স চাকরিবিধি মেনে করার সুযোগ রাখা আছে।"
এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, "কোনো কর্মীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই। সবার জন্য একই নিয়ম করা হয়েছে। বিগত সময়ের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা হয়েছে। দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও সরকারের উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা এই নীতিমালার লক্ষ্য।"
কিছুক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য পূর্বশর্ত থাকবে প্রশিক্ষণ
ক্যাডার কর্মকর্তাদের কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামুলকভাবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই নীতিমালায়। এসব প্রশিক্ষণ কর্মকর্তাদের পরবর্তী ধাপের পদোন্নতির শর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
উপসচিবদের পরবর্তী পদোন্নতির জন্য বাধ্যতামুলকভাবে উচ্চতর প্রশাসন ও উন্নয়ন কোর্স (এসিএডি) নামের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে। এর মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১০ সপ্তাহ, যার মধ্যে ১০ দিনব্যাপী একটি বৈদেশিক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভূক্ত থাকবে।
সরকার মনে করলে উপসচিবদের বাইরে ক্যাডার বা সার্ভিসের সমমর্যাদার অন্যান্য কর্মকর্তাদেরও এ প্রশিক্ষণে অন্তর্ভূক্ত করতে পারবে।
একইভাবে যুগ্ম সচিবদের পরবর্তী পদোন্নতির জন্য বাধ্যতামুলকভাবে সিনিয়র স্টাফ কোর্স (এসএসসি) নামের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে। এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৮ সপ্তাহ, যার মধ্যে ১০ দিনব্যাপী একটি বৈদেশিক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভূক্ত থাকবে।
অতিরিক্ত সচিবদের জন্য পলিসি প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কোর্স আয়োজন করা হবে।
সিভিল সার্ভিসের সকল ক্যাডারদের স্ব স্ব ক্যাডারের চাকরির সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে আয়োজিত প্রশিক্ষণে বাধ্যতামুলকভাবে অংশ নিতে হবে। ক্যাডার বহির্ভূত কর্মচারীদেরও প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।
যথাযথ কারণ ছাড়া প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রশিক্ষণকে চাকরি স্থায়ী হওয়ার শর্ত হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে
কোনো কর্মচারী সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ না করলে তার চাকরি স্থায়ী হবে না। এমনকি যথাযথ কারণ ছাড়া চাকরিতে প্রবেশের দুই বছরের মধ্যে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না নিলে তাকে চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া যাবে।
বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে কোনো ক্যাডার কর্মচারী অকৃতকার্য হলে তিনি পরবর্তীতে একবার প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
সাধারণ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মেয়াদ হবে ৬ মাস। প্রশিক্ষণকালীন একটি সময় স্থানীয় প্রশাসন ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে। যেসব কর্মচারী নন ক্যাডার পদ থেকে ক্যাডারভূক্ত হবেন তাদের জন্য বিশেষ বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এর মেয়াদ হবে ন্যুনতম ২ মাস।
যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ অগ্রগাধিকার পাবে
২৬ টি ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। মন্ত্রণালয়গুলো যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তৈরি করবে সেখানে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।
প্রশিক্ষণে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও মৌলিক কাঠামো, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস, রাষ্ট্রের উন্নয়ন আকাঙ্খা ও পরিকল্পনা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সুশাসন, প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, জনসেবার উন্নয়ন, তদারকি ও পরীবিক্ষণ, মূল্যায়ন ও গবেষণা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, উন্নয়ন অর্থনীতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও ব্লু ইকোনোমি।
প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে প্রশিক্ষণ বিষয়ক একটি আলাদা অধিশাখা খোলা হবে।
মো. সহিদউল্লাহ বলেন, "মন্ত্রণালয়গুলো থেকে প্রশিক্ষণের চাহিদা সংগ্রহ করা হয়েছে। জনপ্রশাসন, অর্থ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চাহিদগুলো আলাদা আলাদা। এর প্রেক্ষিতে বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব বিষয়ের মধ্যেই থাকতে হবে। চেষ্টা করা হয়েছে সরকারির চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে।"
কর্মকালীন উচ্চশিক্ষা
সরকারি চাকরিজীবীরা দাপ্তরিক সময়ের বাইরে সশরীরে অংশ নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারবেন। তবে উচ্চশিক্ষার বিষয় হতে হবে চাকরি বা কর্মক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট। এজন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও নিতে হবে।
চাকরিজীবীরা মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য একবারই অনুমতি পাবেন। মাস্টার্স বা এম.ফিল ডিগ্রি অর্জনের জন্য তিন বছর আর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য পাঁচ বছর সময় পাবেন।
পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা, মাস্টার্স, এম.ফিল, পিএইচডি অর্জনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা হবে ৪৫ বছর। কর্মকালীন উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে এ বয়সসীমা হবে ৫০ বছর। আর পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ, ফেলোশীপ ও মেন্টরশীপের জন্য বয়সসীমা হবে ৫৪ বছর।
কর্মকালীন উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশে বা বিদেশে কোনোভাবেই অফিস সময়, অফিসের জনবল, যানবাহন, সরঞ্জাম ও সরকারি কর্মচারী হিসেবে প্রাপ্য অন্য কোনো সুবিধা ব্যবহার করা যাবে না।
বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস অথবা সরকার নিয়ন্ত্রীত অন্য কোনো সংস্থায় চাকরিকালীন উচ্চ শিক্ষা নেওয়া যাবে। তবে ওই পদে পদায়নের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কোর্স শেষ করতে হবে।
চাকরিজীবীরা দেশি প্রতিষ্ঠানে এলএলবি, সিএ, সিএমএ, এনডিসি ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন। এছাড়া প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনালস, মেম্বার অব দ্য চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড সাপ্লাই এবং সমজাতীয় অন্যান্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন।
একজন চাকরিজীবী চাকরিতে যোগদানের পর প্রেষণে বা অধ্যয়ন ছুটিতে মাত্র একবার মাস্টার্স কোর্সে অংশ নিতে পারবেন। চাকরিতে যোগদানের পরে এম.ফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলে দ্বিতীয় করা যাবে না। কর্মজীবনে ডিপ্লোমা কোর্সে অংশগ্রহণের মোট মেয়াদ হবে ১২ মাস।
কোনো কর্মচারী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে অফার লেটারে উল্লেখ করা সময়ের মধ্যে ওই কোর্স শেষ করতে হবে। অনিবার্য কারণে নির্ধারিত সময়ে কোর্স শেষ না হলে মাস্টার্সের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছয় মাস, এম.ফিল ও পিএইচডি কোর্সের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক বছর এবং ডিপ্লোমা কোর্সের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন মাস বাড়তি সময় বিদেশে থাকা যাবে।
নির্ধারিত সময়ে কোর্স শেষ না হলে কর্মচারীকে দেশে ফিরে আসতে হবে। স্ববেতনে ৫ বছর ডেপুটেশন পায় একজন সরকারি কর্মচারী।
অতিরিক্ত সচিব মো. সহিদউল্লাহ বলেন, "যে বিষয়ের ওপর উচ্চশিক্ষা নেবেন, সেই বিষয় যাতে কর্মক্ষেত্রে কাজে আসে এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পছন্দের তিনটি ক্রম দিতে হবে। সরকারের চাহিদার সঙ্গে কর্মকর্তার পছন্দ মিলিয়ে বিষয় চুড়ান্ত করা হবে। শিক্ষা শেষে সে অনুযায়ী তাকে পদায়নও করা হবে। মোদ্দা কথা চেষ্টা করা হবে, তার অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে।"
পলিসি ডায়ালগ
সিনিয়র সচিব ও সচিবদের জন্য বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি) অথবা বিসিএস প্রশাসন একাডেমি বছরে কমপক্ষে একবার পলিসি ডায়ালগের আয়োজন করবে। এতে সরকারি, বেসরকারি ও সরকার সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেরও অংশগ্রহণ থাকতে পারবে।
কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে ব্যয় নির্বাহের উৎস প্রদর্শন করতে হবে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব পরিহারের জন্য বেসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ নেওয়া যাবে না। তবে আন্তর্জাতিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে নিমন্ত্রণের ভিত্তিতে এ জাতীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া যাবে।