হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে
রক্তের রোগের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল ১ বছর বয়সী শিশু সাইদুর রহমান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জ্বর আসে তার; ডেঙ্গু হিসেবে সনাক্ত হয় সেই জ্বর। চারদিন ধরে শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের পেয়িং বেডে চিকিৎসাধীন সাইদুর।
শিশুটির মা শাহনাজ বেগম দ্য বিজেনস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাচ্চাটার থ্যালাসেমিয়া আছে বলে ধারণা করছে ডাক্তাররা। সেটির পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসেছি। এক রোগের চিকিৎসা করার জন্য হাসপাতালে এসে আরেক রোগে আক্রান্ত হল। ডেঙ্গুর কারণে থ্যালাসেমিয়া টেস্ট পিছিয়ে গেল।"
সাইদুর রহমানের মত ৫ দিন ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সাড়ে ৪ বছর বয়সী রাফি।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা রাফির মা চম্পা বলেন, "আমাদের বাসার কোথাও মশা নেই। তারপরও কোথা থেকে যে বাচ্চাটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো। বাসায় ছোট আরেকটা মেয়ে আছে, তাকে প্রতিবেশির কাছে রেখে এসে ছেলের চিকিৎসা করাতে হচ্ছে।"
এদিকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাতে গিয়ে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও পিছিয়ে যাচ্ছে; যেমনটা ঘটেছে সাইদুরের বেলায়।
সাইদুর ও রাফির মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছেই। শিশু হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে চাপ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ২৫% শিশু রোগী। আক্রান্তের পাশাপাশি ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর ২১% শিশু।
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এ বছর এত বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি হয়েছে, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ভর্তি হওয়া রোগীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু। এছাড়া জ্বরে আক্রান্ত অনেক শিশুকে বাইরে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবু শিমুল সাঈদ টিবিএসকে বলেন, একাধিক রোগী এক বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছেন আবার কেউ ফ্লোরে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
"এক বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে আছে। জ্বর থাকলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করা উচিত; এটাকে ভাইরাল জ্বর বলে অবহেলা করা উচিত নয়। জ্বর চলে গেলে ভয় শুরু হয়, তখন আপনাকে আরও সতর্ক হতে হবে," বলছিলেন তিনি।
ডা. শিমুল আরো বলেন, ছোট শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা কঠিন কারণ তাদের রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপা যায় না।
"শিশুদের দেহে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টও চ্যালেঞ্জিং। শিশুরা তাদের নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে না এবং যে কোনো সময় শকে চলে যেতে পারে। এজন্য আপনাকে শিশুদের ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকতে হবে," বলেন তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও ১২ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং আরো ২ হাজার ৯৫৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত মোট ৩৬৪ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং এ বছর ৭৮,০২৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ডেঙ্গু সেলের মেডিকেল অফিসার ডা. সোহেল পারভেজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীর হার বাড়ছে।
"সব বয়সি শিশু রোগী পাচ্ছি আমরা। এক দুই দিনের জ্বরে যেসব রোগী আসছে তারা যদি মুখে খেতে পারে, তাহলে তাদের আমরা চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি," বলেন তিনি।
"কিন্তু দিনে তিন বারের বেশি বমি, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা নিয়ে আসা রোগীদের আমরা ভর্তি করছি।"
বর্তমানে ৬৮১ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১১৯। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার কারণে তাদের ঝুঁকি বেশি।
"শিশুরা দিনের বেলা ঘুমায়, আর এডিস মশাও দিনের বেলায় কামড়ায়। তাই তাদের জন্য মশারি ব্যবহার করা আবশ্যক। বিশেষ করে ডেঙ্গু মৌসুমে তাদেরকে জন্য ফুল-লেংথ ট্রাউজার এবং ফুল-হাতা কাপড় পরানো উচিত। "
বুধবার শিশু হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে টিবিএস দেখতে পায়, দুটি ডেঙ্গু ওয়ার্ডের অবস্থা বেশ করুণ। বেশিরভাগ শিশুর স্যালাইন চলছে। একটু বড় শিশুরা মোবাইল দেখছে। কেউ কেউ স্যালাইনের পাশাপাশি শিশুকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। সিবিসি টেস্টের জন্য ওয়ার্ডের নার্সিং স্টেশনে নার্সরা শিশুদের ব্লাড নিচ্ছেন।
কিট সংকটে শিশু হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্ট বন্ধ
এদিকে, টেস্ট কিট সংকটে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়েছে হাসপাতালটি।
শিশু হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টের পাশের ১৩৬ নম্বর রুমে প্রতিদিন অন্তত ২০ জন দরিদ্র রোগীর বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্ট করা হয়।
তবে কিট সংকটের কারণে বুধবার (৯ আগস্ট) হাসপাতালটিতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্ট বন্ধ ছিল।
আবার কবে থেকে বিনামূল্যে টেস্ট শুরু হবে তা জানাতে পারেননি ল্যাব সংশ্লিষ্টরা।