২২ বছরের মধ্যে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু এবার
২০০৩ সালের পর দেশে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে এ বছর। গতকাল পর্যন্ত চলতি বছরে ৩৪ হাজার ১২১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ১৭৭ জনের।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার ০.৫২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত বছর ছিল ০.৪৯ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়; এর মধ্যে মারা যায় ১ হাজার ৩০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি জরুরি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও গতকাল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল।
মৃত্যুর হার বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুনরায় সংক্রমণ ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
তারা বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অব্যাহত রয়েছে। ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষ ডেঙ্গুতে অন্তত একবার আক্রান্ত হচ্ছে। আর যখনই কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, তখনই তার মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এবারে মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার এটা অন্যতম একটি কারণ।
এন্টোমোলজিস্ট এবং অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাড়ার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে।
তিনি বলেন, 'প্রথম কারণ হচ্ছে, অনেকেই জেনে কিংবা না জেনে আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, যারা এবারে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়ে অধিক ঝুঁকিতে পড়ছে। এদের মধ্যে মৃত্যু বেশি।
'দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, অনেকেই জ্বর নিয়ে বাসায় বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন কিংবা অবহেলা করছেন, হাসপাতালে যেতে চাচ্ছেন না। এমন সময়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন, যখন মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।'
তৃতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'দেশে বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ও ডেঙ্গু প্রতিরোধী কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেক হাসপাতালই ডেঙ্গু রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দিচ্ছে। ফলে হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রোগীরা মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছেন।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর প্রতি মাসেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে ৮০ জন মারা গেছে। জানুয়ারিতে ১৪, ফেব্রুয়ারিতে ৩, মার্চে ৫, এপ্রিলে ২, মে মাসে ১২, জুনে ৮, জুলাইয়ে ১২ ও আগস্টে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে।
অক্টোবরের প্রথম তিন দিনেই ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে ১ হাজার ২২ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, এবং ৩ জন মারা গেছে। মৃতদের মধ্যে ২ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার এবং ১ জন বরিশাল বিভাগের।
হাসপাতালে ভর্তির তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ নারী ও ৬৩ শতাংশ পুরুষ হলেও মৃত্যুর হারের তথ্য বলছে, মৃতদের মধ্যে ৫১.৪ শতাংশ নারী ও ৪৮.৬ শতাংশ পুরুষ। ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সি মানুষদের মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি—৪০ শতাংশ মৃত্যুই এই বয়সের মধ্যে হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গতকাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসেই ১২.৩ মিলিয়নের বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ ও ৭ হাজার ৯০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. এমএইচ চৌধুরী লেনিন সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সরকারের ডেঙ্গু প্রতিরোধ প্রচেষ্টার সমালোচনা করে বলেন, 'এবারে বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির বিষয়ে পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু সেই অনুযায়ী স্থানীয় সরকার এডিস মশা নিধনে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকারের মশক নিধনের কার্যক্রম অনেকটাই বন্ধ আছে।'
ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ে কোনো গবেষণাও দেখতে পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এবারে ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো গবেষণার ফলাফল দিতে পারেনি। ফলে বর্ষাকাল দৗর্ঘায়িত হওয়ায় পানি জমছে আর মশার প্রজননও বাড়ছে।'
লেনিন আরও বলেন, 'এডিস মশা দমনে কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। পরপর তিনদিন যদি বড় আকারে সব বাসাবাড়ি, পাবলিক স্পেস, জলাধারগুলোর আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে মশা নিধন করতে পারে, তাহলে দেশের মশা অনেকটাই কমে আসবে এবং ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।'
গত বছর দেশে ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, আর আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু সংক্রমণের সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার থেকে ২১ হাজার হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, অক্টোবরে সংক্রমণের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। নভেম্বরে প্রাদুর্ভাব অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এন্টোমোলজিস্ট কবিরুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে কার্যক্রম ও গবেষণার না থাকায় রোগটি পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কক্সবাজার, বরগুনা, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ ও নরসিংদীতে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটেছে।'
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ইতোমধ্যে দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আগের বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পূর্ববর্তী বছরগুলোতে এই সময়ে ডেঙ্গু কখনও ৬৪ জেলায় ছড়ায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য আরও বলছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে সবচেয়ে বেশি ৭ হাজার ৬৫১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৬ হাজার ৭৯৮ জন এবং ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগে ৪ হাজার ৮৪৯ জন আক্রান্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগে ৭ হাজার ৫৫ জন, বরিশাল বিভাগে ২ হাজার ৯৮৩ জন ও খুলনা বিভাগে ২ হাজার ৬৬৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মৃত্যুর ক্ষেত্রে, ঢাকার দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে সবচেয়ে ৯৫ জন মারা গেছে ডেঙ্গুতে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ২৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২১ জন, বরিশাল বিভাগে ১৮ জন এবং খুলনা বিভাগে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।