ডেঙ্গুতে বাড়ছে মৃত্যু: কবে কমবে প্রকোপ?
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে কমে গেলেও, এবার নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত সেটি অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসে প্রতিদিন গড়ে পাঁচজনের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে মারা যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, অক্টোবরে অতিবৃষ্টি এবং মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবের কারণে ডেঙ্গুর এই দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব দেখা দিয়েছে। তবে তারা আশাবাদী, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে শুরু করবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে চলতি বছরে ডেঙ্গুজনিত মোট মৃত্যু দাঁড়িয়েছে ৪৭১-এ।
একই সময়ে, দেশজুড়ে নতুন করে ৯৯০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ৮৮ হাজার ৭১৫ জনে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম মুশতাক হোসেন ডেঙ্গুর এই দীর্ঘস্থায়ী প্রকোপের জন্য অক্টোবরে অতিবৃষ্টিকে দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, "সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার এক দেড় মাস পর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। এখন বৃষ্টি না হলেও, শীত বাড়লে ডিসেম্বরের শেষে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে।"
তিনি ভবিষ্যতে ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমানোর জন্য মশা নিয়ন্ত্রণ এবং রোগীদের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতির ওপর জোর দেন।
ডা. হোসেন আরও বলেন, "ক্রিটিক্যাল রোগীদের টারশিয়ারি হেলথ কেয়ারে (স্বাস্থ্যকেন্দ্র) চিকিৎসা দেওয়া উচিত, আর অপেক্ষাকৃত কম ক্রিটিক্যাল রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রেই সামলানো সম্ভব। এতে মৃত্যুহার কমানো যাবে। এছাড়া যেসব এলাকায় রোগী বেশি, সেসব এলাকায় মশক নিধনে জোর দিতে হবে।"
চলতি বছরের সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু হয়েছে নভেম্বরে। এ মাসে প্রাণ হারিয়েছেন মোট ১৫৬ জন।
মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট (কীটতত্ত্ববিদ) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে সাম্প্রতিক ব্যাঘাতের ফলে এ বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, "আমরা আগেই অনুমান করেছিলাম, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্র হবে। সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চেইন অব কমান্ডে পরিবর্তন মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।"
অধ্যাপক বাশার বলেন, "ডিসেম্বরের ১৫ তারিখের পর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। তবে যেসব এলাকায় এডিস মশার লার্ভা ও রোগীর সংখ্যা বেশি, সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। এসব এলাকায় লক্ষ্যভিত্তিক মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালানোই সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমানোর চাবিকাঠি।"
তিনি আরও বলেন, "ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব।"
ডেঙ্গুর পুনরায় সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে বলে জানিয়েছেন কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আশরাফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, "দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে জটিলতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। রোগীরা জ্বর সেরে যাওয়ার পর স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যান, কিন্তু বিপদ মূলত সেরে ওঠার সময় বাড়ে।"
ডা. আশরাফুল ইসলাম পরামর্শ দেন, জ্বর সেরে যাওয়ার পর রক্তচাপ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং ব্যথানাশক ওষুধ থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এটি রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে।
তিনি আরও বলেন, "যদি রোগীর ক্ষেত্রে বারবার বমি, রক্তক্ষরণ, নিম্ন রক্তচাপ বা দীর্ঘসময় প্রস্রাব না হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন।"
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সার্বিক কৌশল গ্রহণ না করা হলে প্রতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অব্যাহত থাকতে পারে।
গত বছর দেশে ডেঙ্গুর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দেয়, প্রাণ হারান মোট ১ হাজার ৭০৫ জন। যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।