ল্যাব আধুনিকায়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত, রপ্তানি বাজারে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা
কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তরের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হচ্ছে না। প্রকল্প শেষ করতে আরও এক বছর বেশি সময় চাইছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)।
প্রকল্পের শুরুতে ল্যাবরেটরির জন্য যে যন্ত্রপাতি কেনার কথা ছিল সেখানে নতুন করে ৫১টি যন্ত্র তালিকাভুক্ত করে ২১টি যন্ত্র বাদ দেওয়ার জন্য তালিকা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সাশ্রয় হবে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা, যা দিয়ে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের সক্ষমতা উন্নয়নে কাজ করতে চায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নতুন এসব প্রস্তাবনা যুক্ত করে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে স্থাপিত উদ্ভিদ সংগনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে রূপান্তর প্রকল্পটির সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে, যা এখন যাচাই-বাছাই চলছে। রপ্তানির উদ্দেশ্যে আনা কৃষিপণ্যের ওয়াশিং, সর্টিং, প্যাকেজিং সহ নানা বিষয়ে কাজ করা হয় প্যাকিং হাউজে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু শুরুর প্রায় দুই বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৭ শতাংশ। অথচ এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার কৃষিপণ্যের (সবজি ও ফলমূল) রপ্তানি ২৫-৩০ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি ইউরোপ, আমেরিকার বাজার ধরতে চায়।
ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় সবজি রপ্তানির পরিমাণ ৩৯ শতাংশ এবং ফলমূল রপ্তানির পরিমাণ কমেছে ৮১ শতাংশের বেশি।
নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পূর্বে বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে একটি স্থায়ী বাজার তৈরির প্রচেষ্টা থেকেই দেশের একমাত্র কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজটির আধুনিকায়নের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাওয়া মানে রপ্তানি বাজারেও দেশের অবস্থান নিয়ে পিছিয়ে পড়া। কারণ ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর রপ্তানির উপর ২০ শতাংশ ভর্তুকি বন্ধ হয়ে গেলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে রপ্তানিকারকদের।
কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়ার পূর্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। কমিটি ল্যাবরেটরিতে কী কী যন্ত্র দরকার, পূর্ত ও সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুণগত মান বজায় রাখা নিশ্চিত করতে বাজারদর পুনঃনির্ধারণ করা সহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে।
কমিটি সুপারিশ করে পূর্বের যন্ত্র ক্রয়ের তালিকা থেকে ২১টি যন্ত্র বাদ এবং একই সঙ্গে নতুন প্রয়োজনীয় ৫১টি যন্ত্র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেয়। এর ফলে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৪২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বিশেষজ্ঞ কমিটি ১০টি বৈঠক ও ১টি পরিদর্শনের মাধ্যমে ল্যাবের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন ও বাজারদর পুনঃনির্ধারণ পূর্বক সুপারিশ পেশ করে। সাশ্রয় হওয়া টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে অর্থের সংস্থান রেখে ডিপিপি সংশোধনের পরামর্শ প্রদান করে এই কমিটি।
প্রকল্প পরিচালক ড. শামীম আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'ল্যাবের যন্ত্র ক্রয়ের জন্য স্পেসিফিকেশন ও বাজারদর পুনঃনির্ধারনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর প্রেক্ষিতে গঠিত কমিটি যাচাই-বাছাই করে সুপারিশগুলো করে। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য ডিপিপি পরিবর্তন করা প্রয়োজন।'
প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়, যন্ত্র কেনাকাটা থেকে সাশ্রয়ের অর্থ ল্যাব ও প্যাকিং হাউজের জনবলের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, নষ্ট কুল চেম্বারগুলো মেরামত ও অবকাঠামো উন্নয়ন, ল্যাবের স্যাম্পল নিরাপদে স্থানান্তরের জন্য আধুনিক নিউমেটিক স্যাম্পল ট্রান্সফার সিস্টেম ইনস্টল, উন্নত দেশের মতো করে স্যানিটেশন ও হাইজিন অনুসরণের জন্য প্যাকিং হাউজের দুটি ফ্লোরের সংস্কার করার সুপারিশ করেছে কমিটি।
একইসঙ্গে প্যাকিং হাউজের একটি অংশ অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এর সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও তুলে ধরা হয়। হাউজটির অবকাঠামোগত কারণে এখানে অটোম্যাটিক ওয়াশিং ও ড্রাইং প্ল্যান্ট স্থাপনে প্রয়োজনীয় জায়গা নেই। অথচ কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য এ দুটি টুল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া পানি শোধনাগার ভবনটি সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্যাকিং হাউজের মধ্য হতে অফিস স্থানান্তর, অটোম্যাটিক ওয়াশিং ও ড্রাইং প্ল্যান্টের জন্য জায়গার সংস্থান এবং শিফট ওয়ার্কারদের জন্য ডর্মিটরি স্থাপন, রপ্তানি যোগ্য ফল ও সবজি স্থানান্তরে ফর্কলিফট, ট্রাকটর চালিত ট্রলি, মালামাল পরিবহনে বিভিন্ন সাইজের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলি এবং কেন্দ্রের পরিচ্ছন্নতার জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লিনার কিনতে চান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
ল্যাবরেটরির সুষ্ঠু পরিচালনা ও এক্রিডিটেশন পেতে গ্যাস স্টেশন স্থাপন, পাওয়ার স্টেশন আপগ্রেডেশন, ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপন, ফায়ার হাইড্রেন্ট ও ফায়ার এক্সটিংগুইশিন সিস্টেম আপগ্রেডেশন ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে নেট মিটারিং সোলার পাওয়ার সিস্টেম স্থাপনের জন্য যন্ত্র কেনা থেকে সাশ্রয় হওয়া টাকার ব্যবহার করতে চান প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফলমূল ও শাকসবজি রপ্তানি বাড়াতে ঢাকার শ্যামপুরে একটি প্যাকিং হাউজ স্থাপন করে ফল ও শাকসবজির সর্টিং, গ্রেডিং শেষে গুণগতমান যাচাই পূর্বক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু এই প্যাকিং হাউজে কয়েক বছর আগে ল্যাবরেটরি স্থাপন করে অনেক যন্ত্র কিনলেও তা পরিচালনার জনবল ছিল না এবং ল্যাবটিও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
এই ল্যাবটিকে আধুনিকায়নের জন্য ২০২১ সালে ১৫৬.৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি শুরু হয়। কারণ ইউরোপ, আমেরিকার বাজারে কৃষি পণ্যের রপ্তানির জন্য ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্দিষ্ট মান যাচাই বাধ্যতামূলক। ডিপিপি সংশোধনীতে অবশ্য ব্যয় ১.২৫% বৃদ্ধি করে ১৫৮.৩২ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক ড. শামীম আহমেদ বলেন, 'একটু সময় লাগলেও আমরা চাই ল্যাবটি যেন পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করা সম্ভব হয়।'