বান্দরবানে বন্যার পানি নামার পর হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে
বান্দরবানে বন্যা দুর্গত এলাকায় ডায়রিয়া, বমি, জ্বর, চর্ম রোগ ও পেট ব্যথাসহ নানা রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। রোগীর চাপ সামলাতে এবং সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
বুধবার (১৬ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে জেলা সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ভেতরে বিভিন্ন বয়সী মানুষের লাইন। অনেকে আবার সরকারি বিনামূল্যের ওষধ সংগ্রহ করছেন। দীর্ঘক্ষন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকে মাটিতে বসে পড়েছেন। চিকিৎসা প্রত্যাশীদের বেশিরভাগই নারী। শিশুদের নিয়ে আসা অনেক নারীকে বিরক্ত হতে দেখা গেছে।
বর্হিবিভাগে টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা কমপাউন্ডার মো. ওমর ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, আজকে রোগীর ভিড় অনেক বেশি। চর্ম রোগীর সংখ্যাই বেশি।
সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে টিকিট বিক্রি করা হয়। এই সময়ের মধ্যে বুধবার টিকিট সংগ্রহ করেছেন ৩৩৩ জন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী। যাদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এর আগে মঙ্গলবার ২৩১ জন, সোমবার ২১৩ জন ও রবিবার ৩০৬ জন টিকিট সংগ্রহ করেছিলেন।
জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. এস. এম আসাদুল্লাহ জানান, মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছিল ১০১ জন। তাদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ২ জন।
সোমবার রোগী ভর্তি হয়েছিল ৮৬ জন। ৩ জন ডেঙ্গু রোগী এবং ম্যালেরিয়া রোগী একজন। আজকে (বুধবার) ভর্তি রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে এই হিসাবটি বৃহস্পতিবার পাওয়া যাবে।
এদিকে হাসপাতালে ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্সরা জানান, বেশির ভাগ রোগী জ্বর, বমি ও হালকা কাশি নিয়ে ভর্তি হয়েছেন।
শিশু ওয়ার্ডে শারমিন আক্তার নামে এক মা দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাডকে বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বাড়ির ভেতরের কাদামাটি পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে রয়ে গেছে। বাচ্চার বয়স চার মাস। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গত সোমবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার ও নার্সদের থেকে ঠিকমতো সেবা পাওয়া যাচ্ছে।
শহরের ইসলামপুর ট্যাংকি পাহাড় এলাকায় থেকে আসা আসমা আক্তার নামে আরেক নারী বলেন, তিন মাস বয়সী মেয়েকে মঙ্গলবার শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করেছি। নলকূপের পানি খাওয়ার পর থেকে বাচ্চাটি ডায়রিয়া ও বমি করতে থাকে। অবস্থা খারাপ দেখে হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হয়েছি।
জেলা সদর হাসপাতালের সিনিয়র নার্স মনজুরাণী চাকমা বলেন, বন্যার আগে ডেঙ্গু রোগী থাকলেও এত চাপ ছিল না। বন্যার পরে এখন প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে। বহির্বিভাগেও রোগীদের ভিড় লেগে আছে। প্রতিদিন নতুন রোগী এসে ভর্তি হচ্ছে। তারপরও আমরা আন্তরিকতার সাথে সবাইকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে আক্রান্ত হয়েছে লামা উপজেলা। সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাতসহ সবকিছু বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটিও বন্যা কবলের হাত থেকে বাদ যায়নি। প্রায় তিন দিনের মত বন্যার পানিতে ডুবেছিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। তবে বন্যার ধকল কাটিয়ে সেবা দিতে শুরু করেছে বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মহিউদ্দিন মোরশেদ বলেন, বন্যায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তারপরও আমরা বন্যা দুর্গত মানুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে। জ্বর, ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি, শরীরে চর্মরোগ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন রোগীরা।
রোয়াংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মংহ্লা প্রু মারমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাস্তাঘাটে কাদামাটি ছিল। পাহাড়ে ধসে মাটি রাস্তার ওপর পরে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। রাস্তা চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু হওয়ার পর থেকে রোগী বাড়তে শুরু করেছে। রোগীদের সেবা প্রদানে কোন ধরণের অবহেলা যাতে না হয় সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বান্দরবান সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এস. এম আসাদুল্লা জানান, বন্যার পানি নেমে গেলে স্বাভাবিকভাবে পানিবাহিত নানান রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। তবে একটু সচেতন হলেই বন্যার পরবর্তী নানা রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। রোগের উপসর্গ দেখা দিলে বিচলিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার কথা জানান তিনি।
এদিকে পানি সরলেও এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠেনি বান্দরবান জেলা। এখনও বিদ্যুৎ ও সড়ক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে রুমা ও থানচি উপজেলা। শহরের 'বনানী স মিল' এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বান্দরবান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ আমির হোসেন বলেন, শহরে ৯০ ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ দিতে পেরেছি। আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে শহরের শতভাগ বিদ্যুৎ চালু হবে। রোয়াংছড়িতে মঙ্গলবার বিদ্যুৎ চালু করা গেছে। থানচি ও রুমার সড়ক এখনো বিচ্ছিন্ন আছে। সড়ক মেরামত হয়ে গেলে সেখানেও দ্রুত বিদ্যুৎ চালু করা হবে।
বান্দরবানে আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এক সপ্তাহের ভারি বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়ে পড়ে বান্দরবানের নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দী হয়ে পড়ে হাজারো পরিবার। অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যায় জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবাও দুর্বল হয়ে যায়। গোটা বান্দরবান জেলা কার্যত কয়েক দিন বিচ্ছিন্ন ছিল সারাদেশের সঙ্গে। এখন বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে জেলার বেশির ভাগ এলাকায়।