বৃষ্টিতে আমন রোপণে বড় অগ্রগতি
জুলাইয়ের তপ্ত রোদ ও খরার প্রভাবে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া সদরের কৃষক গোলাম মুক্তাদির এ বছর আমন চাষ না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আগস্টের শুরু থেকেই সারাদেশে ধারাবাহিকভাবে বৃষ্টি শুরু হয়, যা শুধু গোলাম মুক্তাদিরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে প্রভাবিত করেছে তাই নয়, সারাদেশের কৃষকদের দ্রুত আমন রোপনে উদ্বুদ্ধ করছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সর্বশেষ ১৪ আগস্ট পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৫৮.৮৪ শতাংশ জমিতে আমন রোপন হয়েছে, যা জুলাইয়ের ২৫ তারিখে ছিল মাত্র ১২.৮২ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে নতুন করে ৪৬ শতাংশ জমি চাষের আওতায় এসেছে।
এ বছর ৫৯.৩৩ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বৃষ্টিনির্ভর ধান উৎপাদনের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মৌসুমে বড় কোন দুর্যোগ না হলে দেড় কোটি টন চাল উৎপাদন হয়।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠের তথ্য আসতে কিছুটা সময় লাগে। তাদের কাছে মাঠের যে পরিস্থিতির বর্ণনা আসছে, তাতে করে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি জমিতে আমন রোপন শেষ হয়েছে। রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন অঞ্চলেই দ্রুত আমন চাষের পরিমাণ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
দুপচাঁচিয়া সদরের কৃষক গোলাম মুক্তাদির টিবিএসকে বলেন, 'এলাকার অনেকের মতো আমিও এবার আমন ধান চাষ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বৃষ্টি হওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত বদল করেছি এবং ইতিমধ্যে ৪ বিঘা জমিতে ধান রোপন করেছি।'
গত মাসের তীব্র রোদ, তাপমাত্রা ও খরার কারণে অনেক কৃষকই আমন চাষ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আবার অনেকে সেচ পাম্প বসিয়ে আমন রোপন করছিলেন। কিন্তু সেচ পাম্পের মাধ্যমে আপন রোপনের হারটা ছিল খুবই ধীরগতির।
কৃষিকাজে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর তথ্য মতে, আমন মৌসুমে ৬১ শতাংশ কৃষক ধান রোপনে সরাসরি বৃষ্টির পানির উপর নির্ভর করে। এবারে বৃষ্টির অভাবে যেসব কৃষক সেচ পাম্পের সঙ্গে চুক্তি করেছেন বা সেচে ধান লাগিয়েছেন বৃষ্টি এসে সেই নির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছুটা খরচ বাড়িয়ে দিবে।
ধুনটের বেড়ের বাড়ীর কৃষক আবু সাঈদ বলেন, বৃষ্টিটা জুলাইয়ে হলে সেচ পাম্পের সঙ্গে চুক্তি করতে হতো না। তবে বৃষ্টি হওয়াতে চারার বৃদ্ধি ভালো হবে।
সারাদেশের কৃষকদের কাছে গত দুই সপ্তাহের নিয়মিত বৃষ্টি বড় আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই বৃষ্টিতেই কৃষকরা দ্রুত জমি তৈরি করছেন এবং ধান রোপন করছেন। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ধারাবাহিক এই বৃষ্টির কারণে এবার আমন চাষ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বৃষ্টিপাতের প্রভাবের একটা খন্ডচিত্র বুঝা যাচ্ছে বগুড়াতে। টিবিএসের বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম জানান, বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগে বগুড়ায় আমন চাষ হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪৮ হেক্টর জমিতে। এবার সেখানে চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমিতে আমন রোপন করা হয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ শতাংশ। যার বেশিরভাগই হয়েছে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে।
বগুড়া জেলা আবহাওয়া দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমনের মৌসুমের আগে বিশেষ করে ২০১৯ সালে জুন-জুলাই মাসে জেলায় বৃষ্টিপাত হয় ৭৫৮ মিলিমিটার। ২০২৩ সালে জুন-জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৭৫ মিলিমিটার। অথচ এই দুই মাসে বগুড়ায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার দরকার ৭৫০ মিলিমিটার। অর্থাৎ এবার স্বাভাবিকের চেয়ে জুন-জুলাইয়ে ৪৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত কম হয়েছিল। আর আগস্টের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৮৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার। তবে গত ১৫ দিনে (১৫ আগস্ট পর্যন্ত) বগুড়ায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪৩৬ মিলিমিটার। অর্থাৎ চলতি মাসের ১৫ দিনে প্রায় ১৫১ মিলিমিটার বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া (সম্প্রসারণ অনুবিভাগ) টিবিএসকে বলেন, 'বৃষ্টির কারণে আমন রোপন দ্রুত হচ্ছে। কৃষক বিকল্প সেচের মাধ্যমে চাষ শুরু করলেও বেশিরভাগই আসলে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষায় ছিল। এখন পর্যন্ত প্রায় লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ ধান রোপন শেষ হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলায় অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ৩৮৩ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৭১ হাজারেরও বেশি। ১২,৮০০ হেক্টর জমির আউশ ধান, আমন ধান, আদা, হলুদ, শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে করে পাশের জেলা থেকে চারার সরবরাহ ঠিক রাখা হয়। কারণ প্রতিটি জেলাতেই অতিরিক্ত চারার সরবরাহ রয়েছে। যেমন ফেনী, কুমিল্লায় বাড়তি চারার সরবরাহ রয়েছে।
এদিকে এক-দুটি অঞ্চলে ব্যতিক্রম কিছু চিত্রও রয়েছে। যেমন, নাটোর। সারাদেশের বৃষ্টিপাতের মধ্যেও সেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি নেই। যেমন নাটোরের সিংড়া উপজেলায় গত ১০-১২ দিনে মাত্র ৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বিকল্প সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে আমন রোপনের কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, 'যেখানে বৃষ্টি কম হচ্ছে সেসব এলাকাতে বিকল্প সেচ ব্যবস্থায় চাষাবাদ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ আমাদেরকে খুব সহযোগিতা করছে, দ্রুত লাইনগুলোর সংযোগ দিয়েছে।
গত বছর আমন মৌসুমেও ব্যাপক খরার প্রভাব পড়েছিল, যেখানে ৫-৬ লাখ সেচ পাম্প দিয়ে সারাদেশে আমন রোপন করা হচ্ছিল। কিন্তু শঙ্কা তৈরি হয়েছিল কম আবাদের। শেষ দিকে এসে সারাদেশে দুই-তিন দিনের ভারী বৃষ্টিপাতে আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়।