ভারী বৃষ্টি আর তীব্র জোয়ার, ব্যাপক ফসলহানিতে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত এবং তীব্র জোয়ারে নষ্ট হয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির আমন ধানের বীজতলা ও চাষাবাদ। নষ্ট হয়ে গেছে সকল ধরনের শাকসবজি। মাঠের পর মাঠ জুড়ে এখন পানি ছাড়া আর কিছুই নেই।
কোনো কোনো কৃষক কমপক্ষে তিনবার বীজতলা তৈরি করেও একগোছা ধান গাছ বাঁচাতে পারেননি। এ অবস্থায় কৃষকদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। অতীতে বৃষ্টি ও জোয়ারের পর এমন দীর্ঘ সময় জলাবদ্ধতার নজির দেখেনি বলে জানান কৃষকরা।
গত বছর লক্ষ্মীপুরে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছিল। এ বছরের মোট চাষের তথ্য এখনও হিসাব করা হয়নি।
কৃষি কর্মকর্তাদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে আমন ধানের ৫০% থেকে ৬০% ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ উপপরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দিন ফিরোজ জানান, "দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার পর আমরা মাঠ পর্যায়ে নেমে ক্ষয়ক্ষতির খোঁজ নিচ্ছি। বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে দেখেছি আমন ধানের বীজতলা এবং বিভিন্ন সবজি ক্ষেত পানির নিচে চলে গেছে।"
তিনি বলেন, "আগামী রোববারের মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরবো। পরে করণীয় বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।"
লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর তীরের চর মার্টিন গ্রামে গিয়ে দেখা যায় মাঠের সবগুলো বীজতলা ও সবজি ক্ষেত পানির নিচে। ২-১টি বীজতলায় পানি কম থাকলেও ধানগাছ মরে পঁচে গেছে।
শুক্রবার (৯ আগস্ট) বিকেলে আমন বীজতলা থেকে হাত দিয়ে সেচে পানি বের করছিলেন কৃষক মোস্তফা মাঝি (৬০)। তিনি জানান, জুলাই মাসের শুরুতে তিনি ১ মণ (৪০ কেজি) ধান বীজতলায় বপন করেছিলেন। ২১-২৫ জুলাইয়ের অস্বাভাবিক জোয়ারে তার বীজতলা নষ্ট হয়। এরপর পুনরায় নিজ এলাকা থেকে ২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে আবারো ৬৩ কেজি ধানের বীজ বপন করেন। ২৬ জুলাই থেকে টানা বৃষ্টিতে সেই বীজতলাও এখন পানির নিচে।
"ছোট চারাগাছগুলো মরে গেছে। তৃতীয়বার বাজার থেকে প্রতিকেজি ১৪০ টাকা দরে ১০ কেজি ধান এনে আবারো বীজতলা করেছিলাম। কিন্ত গত ২ দিনের বৃষ্টির পানিতে শেষবারের ধানগুলোও এখন পানির নিচে। আমি আর পারছি না ভাই," কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলছিলেন এই কৃষক।
চর রমনী মোহন গ্রামের কৃষক মো. আবদুর রশিদ (৫০) জানান, তিনি এ পর্যন্ত ২ বার বীজতলা তৈরি করেছিলেন। দুইবারই বীজতলা অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন তার কাছে আর কোনো ধানের বীজ নেই।
লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরের চর লরেঞ্চ গ্রামের কৃষক হাজী নুর মোহাম্মদ জানান, ১৯৯৮ সালের পর তার এলাকায় বৃষ্টির পানির এমন ভয়াবহ চিত্র আর কখনো দেখেননি তিনি। তার বীজতলায় ধানের ছোট চারা গাছের ওপরে প্রায় ২ ফুট পানি। নিচে চারাগাছ পঁচে গেছে বলে জানান তিনি।
যা বলছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা
নোয়াখালী কৃষি প্রশিক্ষণ ইন্সিটিটিউটের অধ্যক্ষ ড. জাকির হোসেন জানান, "আমি নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন কৃষকদের সাথে কথা বলে যে চিত্র পেয়েছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে এবার আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে।"
তিনি আরো বলেন, "আমি কৃষকদের বিলম্বে বপন করা যায়, এমন একটি ধান চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। তাতেও সমস্যা হলে পানি নেমে যাওয়ার পরপরই শাকসবজি এবং অন্যান্য ফসল আবাদের পরামর্শ দিয়েছি।"
লক্ষ্মীপুরের মেঘনা তীরের বাসিন্দা স্থানীয় সংবাদকর্মী আবদুর রহমান বিশ্বাস জানান, "বিগত বছরগুলোতে শুধু আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে জোয়ার হলে একদিন নদীর পানি ওপরে উঠে আসতো। তারপর ২-৩ ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হয়ে যেতো। কিন্ত এ বছরের ২১ জুলাই তারিখে মেঘনায় অস্বাভাকি জোয়ারের পানি ওপরে উঠে আসে— যা ২৮ জুলাই পর্যন্ত স্থির ছিল। এমন ঘটনা অবিশ্বাস্য।"
লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ডাকাতিয়া নদী সুরক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক ও জেলার রায়পুর উপজেলার বাসিন্দা আজম খান জানান, "এলাকাটি অনেক উঁচু হওয়া সত্ত্বেও গত টানা ১৫ দিন যাবত পুরো উপজেলার সকল কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এবছর আমন ধান আর হবে না।" এমন জলাবদ্ধতার জন্য তিনি খাল বিলে অবৈধ দখলকে দায়ী করেন।
এদিকে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের লক্ষ্মীপুর অফিসের আবহাওয়া অবজার্ভার মো. সোহরাব হোসেন জানান, গত ২১ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত রামগতি আবহাওয়া অফিস ৪৭৯ মিলিমিটার বৃৃষ্টিপাত রের্কড করেছে। এরমধ্যে ৩০ জুলাই একদিনেই বৃষ্টি হয়েছে ১০১ মিলিমিটার। অন্যদিকে, ৯ আগস্ট পর্যন্ত ২৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।