কম বৃষ্টিপাতে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে আমন উৎপাদন
বর্ষাকালেও সারাদেশে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, এ বছর বৃষ্টিনির্ভর ফসল আমন ধানের উৎপাদনকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) তথ্যমতে, চলতি জুনের ২১ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ২৩.৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। যদিও এরমধ্যে সিলেট, রংপুর এবং ময়মনসিংহে বাড়তি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে এই জায়গাগুলো বাদে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলেই নেই পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত।
সপ্তাহ দুয়েক ধরেই দেশের আকাশে মেঘ জমলেও বৃষ্টি হচ্ছে না। কোথাও কোথাও বৃষ্টি হলেও তা স্বাভাবিকের তুলনায় কম। অথচ বৃষ্টি নির্ভর চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৌসুমের বোনা আমন রোপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে; রোপা আমন আবাদের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন কৃষকরা। এ অবস্থায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ার ধারাবাহিকতা থাকলে, তা আমনের চাষাবাদে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য ব্যাপক গবেষণায় গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে করে এই সময়গুলোতে আসলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সরকার কি কি সহযোগীতা করতে পারে, তা আগে থেকেই পরিকল্পনায় থাকতে হবে।"
"তা না হলে চালের ধারাবাহিক উৎপাদন ঠিক রাখা কষ্টকর হয়ে পড়বে," বলেন তিনি।
এদিকে কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, বোরো মৌসুমের চেয়ে অনেক বেশি জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। গত মৌসুমে ৫০.৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে— যেখানে আমনে জমির পরিমাণ ছিল ৫৭ লাখ হেক্টরের বেশি।
এবারো লক্ষ্যমাত্রা ৫৭.১৮ লাখ হেক্টর জমিতে আপন রোপনের। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না থাকলে এই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন রোপন সম্ভব হবে না।
সারাদেশেই এই মৌসুমের চালের উৎপাদন পুরোপুরি বৃষ্টি নির্ভর, বৃষ্টির জন্যই কৃষকরা অপেক্ষা করে থাকেন। আমন মৌসুমে গড়ে ১.৫ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত মৌসুমে ৫৭.৫০ লাখ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে— যেখানে চালের উৎপাদন হয়েছে ১.৬৭ কোটি মেট্রিক টন, যা তার আগের বছরের চেয়ে ৭.৯৭ শতাংশ বেশি।
আমন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ
আবহাওয়ার এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যেই কৃষি বিভাগ ৫৭.১৮ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে— যেখানে সম্ভাব্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১.৭৫ কোটি মেট্রিক টন চাল। তবে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হলে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা কৃষিবিদদের।
গত দুই আমন মৌসুমেই বৃষ্টির জন্য কৃষককে ভুগতে হয়েছে। বৃষ্টি কম হওয়ায় দেশের অনেক অঞ্চলেই সেচ মেশিন বসিয়ে ধান রোপন করা হয়েছিল। গত বছরই প্রায় ৪ লাখের বেশি এবং এর আগের বছর ৬ লাখের বেশি সেচ পাম্প বসাতে হয়েছিল। এতে করে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, আমনের আবাদ হয় দুই ভাগে। আগাম হিসেবে প্রথমে লাগানো হয় বোনা আমন। দ্বিতীয় ধাপে বীজতলা তৈরি করে রোপা আমন রোপন করা হয়। প্রথম ধাপের বোনা আমন লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা এবারে ২.৪৮৭ লাখ হেক্টর, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে রোপন শেষ হয়েছে।
আর রোপা আমনের জন্য সারাদেশে বীজতলা তৈরির কাজ চলছে, যেগুলো পর্যাপ্ত বৃষ্টি পেলে মাসখানেক পর থেকেই লাগানো হবে। আবার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না থাকলে বীজতলারও ক্ষতি হয়, যা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, "আমন মৌসুমটাই বৃষ্টি নির্ভর। বৃষ্টি কম হলে সেটা চাষাবাদে প্রভাব ফেলে, দেশের চাল উৎপাদনে প্রভাব ফেলে। গত বছর আমনের সময় অনেক স্থানেই সেচ মেশিন বসিয়ে ধান রোপন করতে হয়েছিল।"
জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে: আবহাওয়া অফিস
তবে চলমান পরিস্থিতির মধ্যেও আশার কথা শোনাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এ মাসে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আগামী মাসে এটি বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ টিবিএসকে বলেন, "দেশে বর্ষাকালে সারা বছরের ৭১ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়। এরমধ্যে জুলাই মাসেই হয় বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত। এবারে গতবছরের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। জুনে দক্ষিণাঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হলেও সিলেটসহ উত্তারঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।"
এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, "বর্ষাকালে আকাশে মেঘ বেশি দেখা গেলেও অধিকাংশ মেঘ সব জায়গায় বৃষ্টি ঝরায় না। তাই গত কয়েকদিন ধরে ঢাকাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দিনের অধিকাংশ সময় মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও সেই মেঘ এসব এলাকায় খুব বেশি বৃষ্টি ঝরায়নি। এটি বর্ষাকালের বৈশিষ্ট।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে মুনসুন এক্সিস ভারতের আসাম, মেঘালয়, নেপাল, বাংলাদেশের সিলেটের কিছু এলাকাসহ পূর্ব-পশ্চিম বরাবর অবস্থান করছে। ফলে বাংলাদেশের মধ্যভাগসহ দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি কম হচ্ছে। জুলাই মাসে এই এক্সিস বাংলাদেশের ওপরে থাকবে, যা ব্যাপক বৃষ্টি ঝরাবে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।"
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারী বৃষ্টিপাতের সময়টা জুন থেকেই হিসাব করা হয়। গত ২১ জুন পর্যন্ত দেশে জুন মাসের স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২৩.৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। তবে সিলেটে ১৭৭ শতাংশ, রংপুরে ১২০ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ৬০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে জুন মাসে। সিলেটে অবশ্য বন্যাও হচ্ছে।
জুনে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৮,৯৮০ মিলিমিটার। গত দুই বছরও জুনে স্বাভাবিকের থেকে কম বৃষ্টিপাত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ২০২৩ সালের জুন মাসে স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ১৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২০২২ সালের একই সময়ে বৃষ্টিপাত কম হয়েছে ৩.৬ শতাংশ, ২০২১ সালে এই পরিমাণ ছিল প্রায় ১৮ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০২০ সালের একইসময়ে প্রায় ২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছিল।
এবারে জুন মাস শেষে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানানো হয়েছিল আগেই।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক টিবিএসকে বলেন, "বর্ষাকালে আকাশে মেঘের উপস্থিতি বেশি দেখা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এবারে অধিকাংশ মেঘেই বৃষ্টি হচ্ছে না, কারণ মেঘ এতাটাই ক্ষুদ্র কণার বৃষ্টি ঝরাচ্ছে, যা মাটিতে আসার আগেই তাপমাত্রার কারণে জলীয়বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। এগুলোকে বলা হয় ফেয়ার ক্লাউড।"